শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, বৈশাখ ১২ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

এডিটর`স চয়েস

ইলম ও যিকির যে কোনো দ্বীনী কাজের প্রাণ

 প্রকাশিত: ১৪:১৮, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১

ইলম ও যিকির যে কোনো দ্বীনী কাজের প্রাণ

[মিরপুর তাবলীগী মারকাযে ১৭-০৪-১৪৪২ হি. মোতাবেক ০৩-১২-২০২০ ঈ. তারিখে প্রদত্ত বয়ান। বয়ানটি মুসাজ্জিলা থেকে পত্রস্থ করেছেন মাওলানা মুহাম্মাদুল্লাহ মাসুম। নযরে সানী করে ছাপার জন্য প্রস্তুত করেছেন মাওলানা মাহমুদ বিন ইমরান। এরপর হুযুর তা আদ্যোপান্ত দেখে দিয়েছেন। -সহ সম্পাদক ]

الحمدُ لله وسلام على عباده الذين اصطفى، وأشهدُ أن لا إله إلا الله وحده لا شريكَ له، وأشهدُ أن محمدا عبدُه ورسوله، اللهم صلِّ على سيدنا ومولانا محمدٍ النبيِّ الأميِّ وعلى آله وسلّم تسليما،أما بعد، فأعوذ بالله من الشيطان الرجيم، بسم الله الرحمن الرحيم:

اَلَمْ یَاْنِ لِلَّذِیْنَ اٰمَنُوْۤا اَنْ تَخْشَعَ قُلُوْبُهُمْ لِذِكْرِ اللهِ وَ مَا نَزَلَ مِنَ الْحَقِّ، وَ لَا یَكُوْنُوْا كَالَّذِیْنَ اُوْتُوا الْكِتٰبَ مِنْ قَبْلُ فَطَالَ عَلَیْهِمُ الْاَمَدُ فَقَسَتْ قُلُوْبُهُمْ، وَ كَثِیْرٌ مِّنْهُمْ فٰسِقُوْنَ. اِعْلَمُوْۤا اَنَّ اللهَ یُحْیِ الْاَرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا، قَدْ بَیَّنَّا لَكُمُ الْاٰیٰتِ لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُوْن.

صدق الله مولانا العظيم وصدق رسوله النبي الكريم، ونحن على ذلك لمن الشاهدين والشاكرين، والحمدُ لله رب العالمين.

আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের শোকর-তিনি আমাদেরকে মাগরিবের ফরয নামায মসজিদে জামাতের সাথে আদায় করার তাওফীক নসীব করেছেন। আবার নামাযের পর কিছু সময় দ্বীনী ফিকির নিয়ে ঈমানী আলোচনার জন্য বসার তাওফীক দান করছেন-আলহামদু লিল্লাহ।

اللّهُمّ مَا أَمْسى بِي مِنْ نِعْمَةٍ أَوْ بِأَحَدٍ مِنْ خَلْقِكَ فَمِنْكَ وَحْدَكَ لَا شَرِيكَ لَكَ، فَلَكَ الْحَمْدُ وَلَكَ الشّكْرُ.

আজকে আমরা শবগুযারিতে হাজির হয়েছি। যদিও পুরো শবগুযারি আমরা সবাই করি না; হয়তো অংশবিশেষ করি। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে ইসতেকামাতের তাওফীক দান করুন।

ইসতেকামাত-এর অর্থ কী?

ইসতেকামাত আরবী শব্দ। এর অর্থ আমরা অনেকে বুঝি। ইসতেকামাত বলা হয়, কোনো নেক আমল গুরুত্বের সাথে নিয়মিত করা। শুরু করলাম, আবার ছেড়ে দিলাম, আবার অনেক দিন পর কোনো সময় হঠাৎ মনে পড়ল, তখন করলাম-এমন নয়। বরং আল্লাহ্র তাওফীক ও মেহেরবানীতে নেক আমলটা যেহেতু শুরু করেছি, আমলটা গুরুত্বের সাথে নিয়মিত করতে থাকব।

তবে কাজটা তো করছি আমি দ্বীনের কাজ হিসেবে এবং আল্লাহকে রাজি-খুশি করার জন্য । সেজন্য যদি দ্বীনেরই তাকাযা আসে-এখন তুমি এই কাজ না করে অন্য কাজ করো, তাহলে ঠিক আছে। অন্যথায় শরীয়তসম্মত ওজর ছাড়া শুধু অবহেলা ও অলসতার কারণে এই আমল আমি ছাড়ব না।

যেমন শবগুযারিতে হাজির হওয়া। এটি একটি নেক কাজ। এই কাজ শুরু করার পর উচিত হল গুরুত্বের সঙ্গে নিয়মিত এই কাজে শরীক হওয়া। হাঁ, যদি শরয়ী কোনো ওজর বা হালাত সামনে আসে কিংবা নিজের কোনো জরুরি কাজ থাকে, যার কারণে শবগুযারিতে হাজির হওয়া সম্ভব হচ্ছে না, তাহলে ভিন্ন কথা। নতুবা শুধু অলসতা বা ভালো না লাগার কারণে অনুপস্থিত থাকা ঠিক নয়; যদিও তা নাজায়েয নয়। নাজায়েয হবে ফরয ও ওয়াজিবের ক্ষেত্রে। ফরয ও ওয়াজিব তার নির্ধারিত সময় থেকে পেছানো যায় না। যেমন ফরয নামায। এর সময় নির্ধারিত। সুতরাং কেউ যদি বলে, মনটা ভালো লাগছে না, আজকে নামায পড়ব না বা পরে পড়ব, সেটা কখনও জায়েয হবে না।

শুনুন! সবসময় যদি নেক কাজের জন্য মন আগাতো এবং মনে ভালো লাগত তাহলে মুজাহাদার কী দরকার ছিল? মুজাহাদার প্রয়োজন তো এজন্যই যে, সবসময় মন প্রস্তুত হয় না। যখন মন অগ্রসর হয়, আলহামদু লিল্লাহ। মন এগুচ্ছে না, তো মনকে এগিয়ে নিতে হবে। মানুষ বলে, মন মজবুত হলে শরীরও চলে। কিন্তু মুজাহাদা বলা হয়, মন যখন চলতে চায় না তখনও শরীর মনকে চালাবে। কেন মন চাইবে না, কেন ভালো লাগবে না, আমি ইনশাআল্লাহ ভালো লাগিয়ে ছাড়ব! নেক কাজের জন্য এরকম মুজাহাদা করা। গোনাহের ক্ষেত্রে এর একদম উল্টো। মনের ইচ্ছা হবে, তবে এই ইচ্ছার কোনো মূল্য নেই। আমার আল্লাহ অসন্তুষ্ট হবেন-এই কাজ আমি কিছুতেই করব না।

যে কোনো নেক আমলের ক্ষেত্রে ইসতেকামাত একটি গুরুত্বপূর্ণ সিফাত। এই সিফাত যদি না থাকে, কোনো নেক আমল নিয়মিতও করা যায় না, গুরুত্বের সাথে ভালোভাবেও করা যায় না।

আমাদের এই শবগুযারির আমল আমরা প্রতি বৃহস্পতিবার নির্দিষ্ট একটি মসজিদে করে থাকি।

তবে শবগুযারি, শবগুযারির সময় ও শবগুযারির স্থান কোনোটাই শরীয়ত নির্ধারণ করে দেয়নি; বরং মশওয়ারার মাধ্যমে আমরা এগুলো ঠিক করেছি। তাই মশওয়ারার মাধ্যমে এগুলোতে পরিবর্তন হতে পারে এবং কেউ যদি শবগুযারিতে শরীক না হয়, বলা যাবে না-সে গোনাহের কাজ করেছে।

এর মানে কখনো এই নয় যে, আগামী সপ্তাহ থেকে আমাদের জন্য ছাড় হয়ে গেছে; আর না আসলেও চলবে। হুজুর তো বলে গেলেন, না আসলে কোনো গোনাহ নেই; আজকে তো অমুক ভাইয়ের তাশকীলের কারণে এসেছি, সামনে যতই তাশকীল করুক, আমি আসব না! খবরদার! আমি এটা বলিনি।

আমি যেটা বোঝাতে চাচ্ছি-কিছু আমল এমন, যেগুলোর সময় শরীয়ত নির্ধারণ করে দিয়েছে। আবার কিছু আমল এমন, যেগুলোর সময় শরীয়ত নির্ধারণ করে দেয়নি, বরং তা মুমিনদের মশওয়ারার ওপর ছেড়ে দিয়েছে। এই দুইয়ের পার্থক্য আমাদের বুঝতে হবে। কিন্তু সে পার্থক্য করা মানে কখনো এই নয়-যে আমলের সময় নির্ধারিত নেই সে আমল আমরা ছেড়ে দেব। বরং উদ্দেশ্য হল, এই দুইয়ের মাঝে যে পার্থক্য সেটা আমার ইলমে থাকা। অর্থাৎ এটা শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত সময় আর সেটা মশওয়ারার মাধ্যমে ঠিক করা সময়। এটা আমার জানা থাকতে হবে। যে আমলের ক্ষেত্রে শরীয়ত সময় নির্ধারণ করে দেয়নি, নির্ধারণ না করার একটা উদ্দেশ্য তো হল, আমলটা যেন বেশি বেশি হয়। প্রয়োজনের সময় যেমন ছাড় নেয়া যায়, আবার সুযোগমত যেন বেশি বেশি করা যায়। কারণ সময় যেহেতু নির্ধারণ করে দেয়া হয়নি, তাই এখন করতে না পারলে পরে করা যাবে এবং আরও বেশি করে করা যাবে।

আজকে কোনো কারণে আপনি পাঁচ কাজ করতে পারেননি, তো পরে সেটা পুষিয়ে নেয়া যাবে। শবগুযারিতে কোনো ওজরের কারণে আসতে না পারলে মনে আফসোস থাকবে, আহারে! আমার রুটিনটা ভঙ্গ হল!

দেখুন, ইসতেকামাত কিন্তু ফরয-ওয়াজিবের ক্ষেত্রে প্রকাশ পাবে না। কারণ সেখানে করা না করার মধ্যে আপনার কোনো ইখতিয়ার নেই। সেটা তো শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত। ফরয, ওয়াজিব ও সুন্নতে মুআক্কাদার জন্য শরীয়ত সময় নির্ধারণ করে দিয়েছে। আমি চাইলেও সেটা পরিবর্তন করতে পারব না। বরং সেখানে আমি ইসতেকামাত করতে বাধ্য। আমার মধ্যে ইসতেকামাত আছে কি না সেটা বোঝা যাবে মুসতাহাব আমলের ক্ষেত্রে। ওই নেক আমলের ক্ষেত্রে যে নেক আমলের জন্য শরীয়ত সময় নির্ধারণ করে দেয়নি, বরং বলেছে, তোমরা মশওয়ারা করে একটা সময় ঠিক করো! করা দরকার; তোমরা তোমাদের সুবিধামতো করো!

এখানে হবে ইসতেকামাতের পরীক্ষা। দেখা হবে, সুবিধামতো একটা সময় ঠিক করার পর আমি সেটার প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছি কি না।

যদি দেখা যায়, অলসতা-অবহেলা করে আমি রুটিন ভঙ্গ করি না, ঠিক রাখি, বোঝা যাবে, আলহামদু লিল্লাহ, আল্লাহ্র রহমতে আমার মধ্যে ইসতেকামাতের সিফাত পয়দা হচ্ছে। আর যদি এমন হয়। আমি ঠিকমত কাজ করি না, একদিন করি আরেকদিন করি না, অলসতা করি, বোঝা যাবে, আমার মধ্যে ইসতেকামাত নেই।

তাহলে আমরা সবাই ইসতেকামাতের সিফাত চাই কি না? অবশ্যই চাই। ইসতেকামাতের সিফাত বোঝা যাবে এভাবে-আমি ইশরাকের নামায নিয়মিত পড়ি কি না? আওয়াবিন নিয়মিত পড়ি কি না? শবগুযারিতে নিয়মিত আসি কি না? পাঁচ কাজ নিয়মিত গুরুত্বসহকারে করি কি না? মসজিদের হুজুরের কাছ থেকে নামায ও কুরআনে কারীম শেখার জন্য সময় নিয়েছি, সেটাতে ঠিকমতো উপস্থিত হই কি না? যদি এমন হয়-হুজুর ঠিকই হাজির, কিন্তু আমি নেই, তাহলে কী হবে? মসজিদে ইমাম সাহেব এলান করে দিয়েছেন-ফরযে আইনের ইলম শেখানো হবে, কুরআন মাজীদ মশক করানো হবে, নামায মশক করানো হবে, সুন্নতের মশক হবে। এরপর হুজুর হাজির, কিছু সাথীও হাজির, আমি প্রথম ক’দিন ছিলাম, এখন আর নেই! এটা কি ইসতেকামাত হল? আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে ইসতেকামাত দান করুন।

কাজ হতে হবে উসূল মোতাবেক

ভাই! আমরা দাওয়াত ও তাবলীগের একটি গুরুত্বপূর্ণ মেহনতের সঙ্গে যুক্ত। আগেও অনেক বার আলোচনা হয়েছে-দাওয়াত অনেক ব্যাপক একটি বিষয়। তার ছোট্ট একটি অংশের সাথে আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে যুক্ত করেছেন-আলহামদু লিল্লাহ। এই যে আমরা পাঁচ কাজের মেহনত করি এবং চিল্লা, তিনদিন ও গাশতে বেরোই-এগুলো দাওয়াত ও তাবলীগের বিশাল ময়দানের একটি ছোট্ট অংশ-সুবহানাল্লাহ। এই ছোট্ট অংশেরই কী প্রভাব এবং কী ফায়দা, সেটা দুনিয়া দেখেছে। যদি আমাদের ত্রুটি আর অবহেলা না হতো, আমরা যদি কাজটাকে উসূল মোতাবেক করতে পারতাম এবং উসূলের বিষয়ে আমাদের কোনো ত্রুটি না হতো, তাহলে উম্মত আরও দেখতে পেতো, এই কাজের কত ফায়দা এবং কত প্রভাব! কিন্তু আমরা অবহেলা করেছি। কাজের উসূলগুলো ভালোভাবে অনুধাবন করিনি এবং সে মোতাবেক কাজ করিনি। আমরা মনে করেছি, কাজ হওয়া দরকার, কাজ করছি, ব্যস! আর কিছু লাগবে না।

নোয়াখালীতে একটা প্রবাদ আছে, ‘দাদায় কইছে বাইনতো ধান, বাইনতে আছে ওদা ধান!’ এখন তো ‘ডিজিটাল’ হয়ে গেছে। আগে ধান ভানতে হত ঢেঁকির মাধ্যমে। তার আগে অনেক কষ্ট-সাধনা করে ধান সিদ্ধ করে শুকানো হতো। এখনও গাঁও-গেরামে আছে। প্রথমে একবার ভাপ দিয়ে ধানগুলোকে বড় কোনো মটকা বা চাড়িতে ভিজিয়ে রাখা হয় কয়েক দিনের জন্য। তারপর আবার সিদ্ধ করে রোদে শুকানো হয়। রোদ ভালো হলে একদিনেও শুকিয়ে যায়। তবে সাধারণত দুই-তিন দিন লেগে যায়। তারপর ধান ভানা হয় ঢেঁকির মাধ্যমে। (এখন অবশ্য ঢেকির প্রচলন উঠে গেছে)। অনেক সময় লাগে। কথা হল, যদি ধান না সিদ্ধ করে, না শুকিয়ে ঢেঁকিতে দেয়া হয়, ধান কি ভানা যাবে? ভানা যাবে, কিন্তু সেখান থেকে আর চাল আসবে না, আসবে যেটা সেটা হয়ে যাবে খুদ বা চালের কণা। সেটা হাঁস-মুরগির খাদ্য ছাড়া আর কোনো কাজে আসবে না।

দাদা বলেছেন, ধান ভানার জন্য। ধান ঢেঁকির নিচে দিয়ে তুষ ছাড়িয়ে তা থেকে চাল নেয়ার জন্য। সে উদ্দেশ্যে নাতি ওদা ধান দিয়ে দিয়েছে। মানে সিদ্ধ না করে, না শুকিয়ে ধান ভানতে গেছে ঢেঁকিতে! ভাবছে, দাদা ধান ভানতে বলেছেন, ভানছি। কিন্তু কিসের উপর ঢেঁকি চাপাচ্ছে সেটা বিবেচনা করছে না। আমাদের কিছু ভাইয়ের অবস্থাও ঠিক এমনই। তারা মনে করে, উসূল ও তরিকামতো হওয়া দরকার নেই, কাজ হওয়া দরকার, ব্যস!

না, ভাই! শুধু কাজ হওয়া দরকার নয়, বরং উসূল মোতাবেক কাজ হওয়া দরকার। দ্বীনী কাজের সবচে বড় উসূল হল সুন্নত। কাজ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত মোতাবেক হতে হবে। কোন্ কাজের কী সুন্নত সেটা জানতে হবে। জেনে সে মোতাবেক কাজ করতে হবে।

অতএব আমাদের এই দাওয়াতী মেহনতেরও উসূল আছে। কুরআন-সুন্নাহ এবং সাহাবায়ে কেরামের সীরাত থেকে সে উসূলগুলো উলামায়ে কেরাম উদ্ভাবন করেছেন। উসূল মোতাবেক হলে আমাদের এই যে ছোট্ট মেহনত, তারও অনেক ফায়দা এবং অনেক প্রভাব।

আপনারা আবার নারাজ হননি তো, আমি যে এটাকে ‘ছোট্ট মেহনত’ বলেছি? কেউ কেউ নারাজ হতেও পারেন; কারণ দাওয়াত ও তাবলীগের মেহনত যে কত বিশাল ও বিস্তৃত সে বিষয়ে আমাদের অনেকের ধারণা নেই। সেজন্য কেউ নারাজ হতেই পারে। কারণ আমরা দেখি, কত বড় কাজ! বিশ্বজুড়ে তার এত ফায়দা! এত তাসীর! আরে ভাই, তাসীর আর ফায়দার কথা তো আমি আগেই বলেছি-কিন্তু এ তাসীর ও ফায়দাও যথাযথ হবে যদি উসূল মোতাবেক হয়।

দেখুন, একটা হল কাজের বিস্তৃতি। আরেকটা হল কাজের গভীরতা। ধরুন, কোনো একটা কাজ বিস্তৃত হয়েছে অনেক, কিন্তু তাতে গভীরতা তেমন একটা নেই। কাজটা মাশাআল্লাহ, খুব ছড়িয়েছে, কিন্তু নিখুঁত ও যথাযথ হয়নি। তাহলে ফল কী হবে? মনে রাখবেন, একটা কাজ সফল হতে হলে তার বিস্তৃতির চেয়ে গভীরতার প্রয়োজন অনেক বেশি। বিস্তৃতি দ্বারা উদ্দেশ্য হল, কাজটা মানুষের মাঝে ছড়ানো। আর গভীরতা বলতে উদ্দেশ্য হল, কাজটা উসূল মোতাবেক হওয়া এবং নিখুঁত ও যথাযথ হওয়া।

এখন একটি উসূলের কথা বলি। আমাদেরকে ছয়টি সিফাতের কথা বলা হয়েছে। কালিমা, নামায, ইলম ও যিকির, একরামুল মুসলিমীন, তাসহীহে নিয়ত এবং দাওয়াত ও তাবলীগ। ষষ্ঠ নম্বরটিকে খুরূজসহ আরো বিভিন্ন নামে বলা যায়। এই ছয়টি সিফাত যাতে যথাযথ ও ভালোভাবে আদায় হয় তার জন্য আরেকটা নম্বর আছে। সেটা হল ‘তারকু মা-লা- ইয়া‘নী’-অহেতুক ও অনর্থক কথা ও কাজ পরিহার করা। ছয়নম্বর ফলপ্রসূ হওয়ার জন্য এর প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য।

 

ইলম ও যিকির যে কোনো দ্বীনী কাজের প্রাণ

এখানে আমাদের অধিকাংশ ভাই সম্ভবত তিন চিল্লার সাথী। সেজন্য আশা করি, সবারই ছয়নম্বর মুখস্থ আছে। তাই সবগুলো নিয়ে বলার প্রয়োজন নেই। আমি শুধু ‘ইলম ও যিকির’ সম্পর্কে দু-একটি কথা বলব -ইনশাআল্লাহ।

কুরআন মাজীদের ২৭ নম্বর পারার শেষ সূরা সূরাতুল হাদীদ। সূরা নম্বর ৫৭। এই সূরার ১৬-১৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন-

اَلَمْیَاْنِ لِلَّذِیْنَ اٰمَنُوْۤا اَنْ تَخْشَعَ قُلُوْبُهُمْ لِذِكْرِ اللهِ وَ مَا نَزَلَ مِنَ الْحَقِّ  وَ لَا یَكُوْنُوْا كَالَّذِیْنَ اُوْتُوا الْكِتٰبَ مِنْ قَبْلُ فَطَالَ عَلَیْهِمُ الْاَمَدُ فَقَسَتْ قُلُوْبُهُمْ  وَ كَثِیْرٌ مِّنْهُمْ فٰسِقُوْنَ،  اِعْلَمُوْۤا اَنَّ اللهَ یُحْیِ الْاَرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا  قَدْ بَیَّنَّا لَكُمُ الْاٰیٰتِ لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُوْن.

এখানে আল্লাহ তাআলা তাঁর মুমিন বান্দাদের উদ্দেশে বলেছেন, মুমিন বান্দাদের কি এখনও সময় হয়নি-আল্লাহ্র যিকির ও তাঁর স্মরণে তাদের দিল নরম হবে এবং হৃদয় বিগলিত হবে, সে সময় কি তাদের এখনও হয়নি-তাহলে আর কবে! আমরা যদি মুমিন হয়ে থাকি, আমাদের উত্তর হবে-আল্লাহ! সময় হয়ে গেছে। আমরা আপনার তাওফীক কামনা করি।

এরপর আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَ مَا نَزَلَ مِنَ الْحَقِّ  অর্থাৎ আল্লাহর পক্ষ থেকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে যে হক নাযিল হয়েছে, সেই হক গ্রহণ করবার জন্য তাদের দিল নরম হবে, সেই সময় কি এখনও আসেনি?

লক্ষ করুন, কী ভাব ও ভঙ্গিতে বলা হয়েছে! আল্লাহ্র যিকির করে, তাঁর নাম শুনে তোমাদের দিলটা নরম হবে, সে সময় কি এখনও আসেনি? তিনি যে হক অবতীর্ণ করেছেন, অর্থাৎ কুরআন, হাদীস এবং ইসলামী শরীয়ত, সেই হক গ্রহণ করার জন্য এবং তার উপর অবিচল থাকার জন্য তোমাদের দিল নরম হওয়ার সময় কি এখনও হয়নি? তাহলে আর কবে হবে!

দেখুন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন-

وَ مَا نَزَلَ مِنَ الْحَقِّ  অর্থাৎ আল্লাহর পক্ষ থেকে যে হক অবতীর্ণ হয়েছে। এই ‘হক’টাই তো ইলম। অর্থাৎ কুরআন-হাদীস এবং ইসলামী শরীয়ত।

তোমাকে কুরআন (যেটা সরাসরি আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ করা), রাসূলুল্লাহর হাদীস (সেটাও আল্লাহ্র পক্ষ থেকে অবতীর্ণ করা) এবং আল্লাহ্র দেয়া শরীয়তের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ভাই! শরীয়তের হুকুম এই। কিন্তু তোমার মন শক্ত, তুমি কবুল করতে চাও না। সরাসরি কুরআনের আয়াত উদ্ধৃত করে বলা হচ্ছে। হাদীস উদ্ধৃত করে বলা হচ্ছে। কিন্তু তোমার মন নরম হয় না। গ্রহণ করতে চাও না। হক মানতে তোমার দিল প্রস্তুত হয় না। এটা কি ভালো লক্ষণ? এটা তো অন্তরের অনেক বড় ব্যাধি। আল্লাহ তাঁর মুমিন বান্দাদের সতর্ক ও উদ্বুদ্ধ করছেন। আরে, তোমাদের সময় কি এখনও হয়নি? আল্লাহ্র যিকিরে তোমাদের দিলটা নরম হবে এবং আল্লাহ্র দেয়া হক গ্রহণে তোমাদের অন্তরটা প্রস্তুত হবে-সে সময় কি এখনও হয়নি?! তাহলে আর কবে হবে! আর কত বিলম্ব হবে! আর দেরি করো না। এবার তোমরা আল্লাহ্র যিকির ও তাঁর স্মরণে মগ্ন হও। তাঁর যিকিরের মাধ্যমে তোমাদের দিলকে নরম কর এবং তাঁর দেয়া ‘হক’ গ্রহণের জন্য তোমাদের অন্তরকে প্রস্তুত কর। এমনভাবে যিকির কর, যাতে অন্তর নরম হয়ে যায় এবং ঈমান তাজা হয়ে যায়।

মুমিন যদি ঈমানী ও ইসলামী যিন্দেগী গ্রহণ করতে চায়, কমপক্ষে দুটো জিনিস আবশ্যক।

এক. আল্লাহ্র নাম শুনে দিল নরম হওয়া এবং তাঁর নাম নেওয়ার জন্য অন্তর প্রস্তুত হওয়া।

আসলে ‘যিকরুল্লাহ’ শব্দটি কিন্তু অনেক ব্যাপক। এক হল-

سبحان الله، الحمد لله، لا إله إلا الله، الله أكبر.

 এ ধরনের তাসবীহ, তাহলীল, দুআ ইত্যাদি পড়া। আরেক হল, শুধু আল্লাহর নাম উচ্চারিত হয়েছে, এতেই দিল নরম হয়ে যাওয়া।

কোনো গোনাহ করছি, আমাকে একজন স্মরণ করিয়ে দিলেন, ভাই! আল্লাহ তো দেখছেন! সাথে সাথে দিল কেঁপে ওঠা। কমপক্ষে এতটুকু মনে আসা যে, আল্লাহ তাআলা আমাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন। মুমিনের সামনে আল্লাহর নাম আসলে বা মুমিন আল্লাহর যিকির করলে, তার দিলটা নরম হবেই। প্রথম দিন হল না,দ্বিতীয় দিন হল না, যিকির করতে থাকলে ইনশাআল্লাহ একদিন না একদিন তার দিল নরম হবেই হবে। নরম হতে যদি বিলম্ব হয়, বুঝতে হবে, কোথাও ত্রুটি হচ্ছে; সে ত্রুটি দূর করতে হবে।

দুই. আল্লাহ তাআলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে যে হক নাযিল করেছেন, অর্থাৎ কুরআন-সুন্নাহর ইলম তথা ইসলামী শরীয়তের ইলম, সেটা গ্রহণ, অনুসরণ ও মান্য করার জন্য অন্তরকে প্রস্তুত করা ও নরম করা।

হক এবং ওহীর ইলমের জন্য অন্তরকে প্রস্তুত করতে হবে। আমাকে কুরআন তিলাওয়াত শিখতে হবে, কুরআনের বিধি-বিধান শিখতে হবে, রাসূলের সুন্নাহ জানতে হবে এবং ইসলামী শরীয়ত সম্পর্কে ইলম হাসিল করতে হবে। কোন্টা হক আর কোন্টা বাতিল সেটা আমাকে জানতে হবে। হক চিহ্নিত হয়ে যাওয়ার পর নির্দ্বিধায় তা গ্রহণ করতে হবে।

এক কথায়-আল্লাহ্র যিকির এবং ওহীর ইলমের জন্য অন্তরকে নরম ও প্রস্তুত করতে হবে। নতুবা মুমিনের ঈমানী যিন্দেগী গঠিত হবে না।

আমরা যে ‘ছয় নম্বরের’ মেহনত করি, সেখানে এই ইলম ও যিকির আছে কি না? আছে। দাওয়াতের মেহনত বলুন, তালীমের মেহনত বলুন, অথবা আত্মশুদ্ধির মেহনত বলুন। এককথায়-দ্বীনের যত মেহনত ও কাজ আছে কোনোটাই ইলম ও যিকির ছাড়া সম্ভব নয়। সুতরাং এই যিকির ও ইলমের জন্য অন্তর প্রস্তুত হতে হবে। এ দুটো ছাড়া ঈমানী যিন্দেগী হবে না। ঈমান তাজা ও মজবুত হবে না। ঈমান তাজা ও মজবুত করতে হলে ইলম ও যিকির অপরিহার্য।

যদি আমরা ইলম ও যিকিরের প্রতি গুরুত্ব না দিই, কী দশা হবে? সেটা আয়াতের পরের অংশে বলা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَ لَا یَكُوْنُوْا كَالَّذِیْنَ اُوْتُوا الْكِتٰبَ مِنْ قَبْلُ فَطَالَ عَلَیْهِمُ الْاَمَدُ فَقَسَتْ قُلُوْبُهُمْ  وَ كَثِیْرٌ مِّنْهُمْ فٰسِقُوْنَ.

অর্থাৎ মুমিনরা তাদের মতো হবে না, যাদেরকে পূর্বে কিতাব দেওয়া হয়েছিল। অতপর যখন তাদের উপর দিয়ে দীর্ঘকাল অতিক্রান্ত হল, তখন তাদের অন্তর শক্ত হয়ে গেল এবং (আজ) তাদের অধিকাংশই অবাধ্য।-[সূরা হাদীদ (৫৭) : ১৬]

আল্লাহ তাআলা হেদায়েতের জন্য ইহুদী-খ্রিস্টানদেরকে কিতাব দিয়েছিলেন। কিন্তু তারা সেগুলো সংরক্ষণ করতে পারেনি; বরং তাতে বিকৃতি সাধন করেছে। তারা যেহেতু ইলম ও যিকিরের চর্চা জারি রাখেনি, সেজন্য তাদের কী অবস্থা হয়েছে-সেটাই আয়াতের পরের অংশে বলা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন-

فَطَالَ عَلَیْهِمُ الْاَمَدُ فَقَسَتْ قُلُوْبُهُمْ وَ كَثِیْرٌ مِّنْهُمْ فٰسِقُوْنَ.

[অতঃপর যখন তাদের উপর দিয়ে দীর্ঘকাল অতিক্রান্ত হল, তখন তাদের অন্তর শক্ত হয়ে গেল এবং (আজ) তাদের অধিকাংশই অবাধ্য। -সূরা হাদীদ (৫৭) : ১৬]

দেখুন, মানুষ গোমরাহ হয় কীভাবে! ইহুদী-খ্রিস্টানদের মধ্যে ইলম ও যিকিরের চর্চা কমতে থাকল এবং কমতেই থাকল। এভাবে দীর্ঘকাল অতিবাহিত হয়ে গেল। বছরকে বছর পার হল। একপর্যায়ে তাদের মধ্যে যিকির আর ইলমের চর্চা বন্ধ হয়ে গেল। গতানুগতিকতা এসে গেল। মানে যিকিরের মধ্যেও অবহেলা এবং ইলমের মধ্যেও অবহেলা। অবহেলা করতে করতে একপর্যায়ে গিয়ে কিতাবটাই হারিয়ে ফেলল। আল্লাহ্র দেয়া হেদায়েতগুলো হারিয়ে ফেলল। পরিণতি কী হল? আল্লাহ বলেন- فَقَسَتْ قُلُوْبُهُمْতাদের দিল শক্ত হয়ে গেল। وَ كَثِیْرٌ مِّنْهُمْ فٰسِقُوْنَ কারো দিল তো এত শক্ত হল যে, একেবারে পুরোপুরি ফাসেক হয়ে গেল।

তাহলে কোনো কাজ যদি দীর্ঘ সময় পর্যন্ত অবহেলার সাথে চলতে থাকে, কাজ যদি তার উসূল মোতাবেক না হয়, কাজের যে রূহ ও প্রাণ, অর্থাৎ ইলম ও যিকির, সেটা যদি না থাকে, বরং ত্রুটি-বিচ্যুতি ও অবহেলা নিয়ে কাজ চলতে থাকে এবং উসূলের খবর না থাকে, তাহলে একসময় কাজ তার প্রাণ হারিয়ে ফেলে এবং তার সাথে যারা সম্পৃক্ত তাদের দিলে যে নরমি সিফাত থাকার দরকার ছিল, সেটা সরে যায় এবং দিল শক্ত হয়ে যায়। কারো দিল তো এত শক্ত হয় যে, সে ব্যাপারে সূরা বাকারাতে আল্লাহ তাআলা বলেন-

فَهِیَ كَالْحِجَارَةِ اَوْ اَشَدُّ قَسْوَةً.

পাথরের চেয়েও বেশি শক্ত হয়ে যায়। দিল যখন শক্ত হয় তখন যিকির আসে না। যিকির ভালো লাগে না। দিলে হক কথা ঢোকে না এবং তা মানতে অন্তর প্রস্তুত হয় না।

তাহলে এখন কী করব? আমার কি আর বাঁচার উপায় নেই? আল্লাহ বলেন, নিরাশ হয়ো না! শোনো-

اِعْلَمُوْۤا اَنَّ اللهَ یُحْیِ الْاَرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا  قَدْ بَیَّنَّا لَكُمُ الْاٰیٰتِ لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُوْن.

জেনে রেখ, আল্লাহই ভূমিকে তার মৃত্যুর পর জীবন দান করেন। আমি তোমাদের জন্য নিদর্শনাবলী সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করে দিয়েছি, যাতে তোমরা বুদ্ধিকে কাজে লাগাও। -সূরা হাদীদ (৫৭) : ১৭

ফসলের জমিন দেখ না, মাসকে মাস বৃষ্টি হয় না। জমিন শুকিয়ে ফেটে চৌচির হয়ে যায়! জমিনে এখন আর ঘাস-লতাপাতা কিছুই ওঠে না। মানে জমিনটা একেবারে মরে গেছে। কিন্তু আল্লাহ এমন জমিনকেও সজীব করেন কি না? মানুষ দুআ করতে থাকে, আল্লাহ! বৃষ্টি দান করুন। আল্লাহ বৃষ্টি দান করেন। তখন জমিন পুনরায় সজীব ও উর্বর হয়ে যায়। ফসল ফলতে থাকে।

আল্লাহ বলছেন, তিনি মরে যাওয়া জমিন যেভাবে জীবিত করেন, মরে যাওয়া দিলও যিন্দা করেন।

জমিন যিন্দা করেন বৃষ্টির পানি দিয়ে আর দিল যিন্দা করেন ইলম ও যিকির দিয়ে।

গোনাহের কারণে, যিকির ও ইলম থেকে সরে যাওয়ার কারণে এবং বে-উসূলির কারণে অন্তর মরে গেছে। আল্লাহ বলছেন, বান্দা! তুমি নিরাশ হয়ো না। তুমি যিকির ও ইলমের প্রতি মনোনিবেশ কর এবং হেদায়েতের বৃষ্টি গ্রহণ কর। আল্লাহ তোমার মৃত অন্তর আবার জীবিত করে দেবেন। তুমি হেদায়েতের আলো পেয়ে যাবে এবং আবার তুমি হকের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে।

এরপর আল্লাহ বলেন-

قَدْ بَیَّنَّا لَكُمُ الْاٰیٰتِ لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُوْن.

আমি তোমাদের জন্য নিদর্শনাবলী সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করে দিয়েছি, যাতে তোমরা বুদ্ধিকে কাজে লাগাও। -সূরা হাদীদ (৫৭) : ১৭

আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাওফীক দান করুন। যদি আমরা এই আয়াতগুলো নিয়ে একটু ফিকির করি, একটু চিন্তা-ভাবনার সাথে পড়ি বা শুনি, তাহলে বুঝতে পারব-ইলম ও যিকিরের গুরুত্ব কত বেশি!

যিকিরের প্রতি মনোযোগী হই

আমাদের এই মেহনতকে যদি আমরা উসূলের সাথে করতে চাই, আমাদেরকে ইলম ও যিকিরের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। আমরা ছয় তাসবীহের আমল করব। সুবহানাল্লাহ একশ বার। আলহামদু লিল্লাহ একশ বার। আল্লাহু আকবার একশ বার। লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ একশ বার। কোনো একটা দরূদ শরীফ একশ বার। যে কোনো ইসতেগফার একশ বার। এগুলো আমরা সকালে একশ বার এবং বিকালে একশ বার পড়ব। না পারলে সকাল-বিকাল মিলিয়ে একশ বার পড়ব। একশ বার করে না পারলে ত্রিশ বার, চল্লিশ বার- যতটুকু পারি পড়তে থাকি। একশ বার পারছি না, এজন্য একবারও পড়ব না-তা কি হয়?

আরেকটা হল তিলাওয়াতের আমল। কুরআন তিলাওয়াত যদি না শিখে থাকি, শিখতে হবে। কেউ হয়ত বলবে, আমাদের পাঁচ কাজে তো তিলাওয়াত শেখা নেই! আরে ভাই, পাঁচ কাজের উদ্দেশ্যই তো হল ঈমান চাঙ্গা ও মজবুত করা। এই ঈমান শেখার মধ্যেই কুরআন শেখা আছে। কুরআন শেখার মেহনত ছাড়া আপনার ঈমান শেখা হয়ে যাবে-এই ধারণা ভুল। কুরআন না শিখে জীবনচিল্লা লাগালেও ঈমান শেখা হবে না। ঈমান শিখতে হলে কুরআন শিখতে হবে। ইসলামের আকীদাগুলো জানতে হবে। ইসলামের আকীদাগুলোকে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআত যেভাবে বিশ্লেষণ করেছে, সে বিশ্লেষণ মোতাবেক প্রতিটি আকীদাকে জানতে হবে, শিখতে হবে এবং বিশ্বাস করতে হবে। ঈমানের শাখাগুলো জানতে হবে। ইসলামে কী কী ফরয করা হয়েছে সেগুলো জানতে হবে। কুরআনে আল্লাহ তাআলা আমাদের জন্য কী কী জিনিস হারাম করেছেন, সেগুলো জানতে হবে। কবীরা গোনাহগুলো সম্পর্কে জানতে হবে।

ঈমান শেখার অর্থ কী?

তাহলে ঈমান শেখার জন্য যে বিষয়গুলো জরুরি তন্মধ্যে অন্যতম হল-

এক. কুরআন শেখা।

দুই. ইসলামী আকীদাগুলো আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ মোতাবেক শেখা।

তিন. ঈমানের শাখাগুলো শেখা।

চার. ইসলামের ফরয, ওয়াজিব ও সুন্নতগুলো জানা।

পাঁচ. কুরআন কী কী হারাম করেছে, সমস্ত হারাম ও অপছন্দনীয় কর্মকাণ্ড এবং কবীরা গোনাহ সম্পর্কে জানা।

ছয়. ইসলাম আমার উপরে কার কী হক ফরয করেছে, সেগুলো জানা। বাবা-মায়ের হক, সন্তানদের হক, স্ত্রীর হক, স্ত্রী হলে তার উপর স্বামীর কী হক, আত্মীয়-স্বজনের হক, বোনের হক ইত্যাদি জানা।

আত্মীয়-স্বজনের হক কি আমরা জানি? বোনের হক কি আমরা জানি? অনেকে মনে করে, বোন যদি বাবার মৃত্যুর পর মিরাস নিয়ে নেয় তার হক শেষ-নাউযুবিল্লাহ। আরে, মিরাস তো ভিন্ন জিনিস। বোন হিসেবে তার আত্মীয়তার হক ভিন্ন জিনিস। বাবার সম্পদের মধ্যে ভাইদের যেরকম অংশ বোনদেরও সেরকম অংশ। ভাইয়েরা যদি সেটা না দিয়ে আটকে রাখে, তাহলে একেবারে আত্মসাৎ করার গোনাহ হবে।

এক বিঘত জমিনও যদি কেউ আত্মসাৎ করে তাহলে ওই অংশের পুরো সাত তবক তার গলায় ঝুলিয়ে দেয়া হবে। সহীহ বুখারীতে উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

مَنْ ظَلَمَ قِيدَ شِبْرٍ مِنَ الأَرْضِ طُوِّقَهُ مِنْ سَبْعِ أَرَضِينَ.

কেউ যদি যুলুম করে এক বিঘত জমিন আত্মসাত করে, (কেয়ামতের দিন) তার গলায় ওই অংশের পুরো সাত তবক ঝুলিয়ে দেয়া হবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২৪৫৩

রক্তের আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে রয়েছেন বোন-ফুফুগণ। ফুফু যদি দাদার ইনতেকালের পর মিরাস নিয়ে থাকে, আর বাবার ইনতেকালের পর যদি বোন মিরাস নিয়ে থাকে, তাহলে নাকি তাদের আর আসা-যাওয়া করা যায় না! সম্পর্ক ও যোগাযোগ সব শেষ। অথচ মিরাস ভিন্ন জিনিস আর আত্মীয়তার হক ভিন্ন জিনিস। মিরাস তো একেবারে তার মালিকানা জিনিস। বাবার মৃত্যুর পর যার জন্য শরীয়ত যতটুকু নির্ধারণ করে দিয়েছে সেটা তো তার জিনিস। সেটা আল্লাহর বিধানের মধ্যেই আছে। দেয়া-না দেয়ার মধ্যে আপনার কোনো এখতিয়ার নেই। আপনাকে সেটা দিতেই হবে। না দিলে আপনি আত্মসাৎকারী সাব্যস্ত হবেন। দিলে আপনি বেঁচে যাবেন। দয়া করে দিচ্ছেন-এমন নয়। এটা দয়া করে দেয়ার জিনিস নয়। এটা তার পাওনা। তার জিনিসই আপনি তাকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন।

অনেকে বলে, হুজুর! দিতে চাই, তারা নিতে চায় না। আরে, নিতে চায় না মানে? আপনি ভাগ করে তারটা তাকে বুঝিয়ে দিন! দিয়ে দেখুন না, নেয় কি না? এই যুগে নিতে চায় না-এই কথার কোনো মূল্য নেই।

না নিতে চাইলেও তাকে দিতে হবে। বোন বলল, ভাই! আমার লাগবে না। ব্যস, আপনিও আর দিলেন না। এটুকুতে আপনি ছাড় পাবেন না আখেরাতে। গোনাহগার হবেন। দুনিয়ার সবকিছু আমরা বুঝি, কিন্তু মানুষের এই ধরনের কথা বুঝি না কেন? বোন কোন্ কথাটা কী উদ্দেশ্যে বলেছে, কীভাবে বলেছে, কোন্ প্রেক্ষিতে বলেছে, এটা বোঝার চেষ্টা করি না কেন? এই কথা একদমই ধর্তব্য নয়। সে না নিক, আপনি জোর করে দিয়ে দিন! ফুফুরটা বাপ-চাচারা না দিয়ে গেলে, এখন সেটা আপনাদের হাতে আমানত। সেই আমানতের এতদিন খেয়ানত হয়েছিল। বাপ-চাচারা দিয়ে যায়নি, এই প্রজন্মকে দিয়ে দিতে হবে। এই প্রজন্ম না দিলে পরের প্রজন্মকে দিতে হবে। যত দেরি হবে তত সবার কাঁধে গোনাহ উঠতে থাকবে।

মিরাস-উত্তরাধিকার এক জিনিস, আর আত্মীয়তার হক ভিন্ন জিনিস। হক হল অসুস্থ হলে খোঁজ-খবর নেয়া। অসুস্থ না হলেও কী অবস্থায় আছে, মাঝে মাঝে খোঁজ-খবর নেয়া। তারাও আসবে, আপনিও যাবেন। কোনো প্রয়োজন দেখা দিয়েছে, আপনার সামর্থ্য আছে, দিন! অসুস্থ হয়ে গেছে, চিকিৎসার খরচ নেই, আপনার সামর্থ্য আছে, দিন! আপনি বিপদে পড়েছেন, তাদের সামর্থ্য আছে, তারাও সহযোগিতা করবে। এগুলো হল আত্মীয়তার হক। সে গরীব অসহায়, তার খরচপাতির কোনো ব্যবস্থা নেই, আপনার খরচের মধ্যে তার ভরণ-পোষণও শামিল করে নিন! এগুলো হল হক।

আর মিরাস-উত্তরাধিকার যেটা সেটা তো যার যে অংশ শরীয়ত নির্ধারণ করে দিয়েছে সেটা তার জিনিস। সেটা তো আপনাকে দিতেই হবে। সেটা তার প্রতি আপনার করুণা পাওয়া নয়; বরং তার বাবার জিনিস, তার অধিকার। আপনি সেটা আটকে রেখেছেন। দখল করে রেখেছেন। যেরকম অন্যের জমিন দখল করলে কবীরা গোনাহ হয়, তেমনি বোনের হক আটকে রাখার কারণেও কবীরা গোনাহ হয়। জমিনে চাষ করছেন, চাষ করে ফসল নিজের ঘরে তুলছেন, সব হারাম হচ্ছে। সব পয়সা হারাম।

ভাই! এটাকে বলে ঈমান শেখা। ঈমান শেখার মধ্যে কুরআন শেখা তো আছেই, সাথে এগুলোও আছে।

বলছিলাম, ছয় তাসবীহের আমল এবং অন্যান্য যিকিরের ইহতিমাম করা। এরকমভাবে কোন্ সময়ের কী দুআ, সেটাও যিকির। সেটা শেখাও যিকির শেখা। যিকিরের কোনো সময় নেই, যিকিরের কোনো পরিমাণ নেই-সুবহানাল্লাহ। ফরয নামাযের পর ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদু লিল্লাহ, ৩৪ বার আল্লাহু আকবার। এরকম কিছু জায়গা আছে, যেখানে যিকিরের পরিমাণ নির্ধারিত আছে। নতুবা সাধারণ হুকুম হল-

اذْكُرُوا اللهَ ذِكْرًا كَثِیْرًا.

যিকির যত বেশি পার করতে থাক। যখন যে হালাতে আছি, শুয়ে আছি, বসে আছি, দাঁড়িয়ে আছি, যিকির করতে থাকি। যেটাই পারি সেটাই বলতে থাকি। সুবহানাল্লাহ, আলহামদু লিল্লাহ, দরূদ শরীফ, যেটা ইচ্ছা সেটাই পড়তে পারি। এমনকি অজুরও প্রয়োজন নেই। কুরআন স্পর্শ করার জন্য অজুর দরকার হয়। কিন্তু মুখস্থ তিলাওয়াতের জন্য অজু ফরয করা হয়নি, বরং সহজ করে দেয়া হয়েছে। আর যিকির তো সর্ব হালাতেই করতে পারি।

ইলম ও যিকির থেকে গাফেল থাকার পরিণতি

এজন্য যিকিরের গুরুত্ব দিতে হবে। নতুবা ওই যে বলা হল! উসূল বাদ দিয়ে, ইলম ও যিকির বাদ দিয়ে এবং গতানুগতিক কাজ করতে থাকলে দিল শক্ত হয়ে যাবে। হক থেকে বিচ্যুত হয়ে যাবে!

আফসোস! এখন হক থেকে সরে গিয়েও খবর নেই যে, হক থেকে সরে গেছে! উল্টো দাবি করে, আমি হকের উপরে আছি!

আমাকে অনেকে জিজ্ঞেস করে, এতাআতী ভাইদের বা সা‘দপন্থীদের কী সমস্যা? কোথায় তাদের সমস্যা? এক এতাআতী ভাই এসে বললেন, হুজুর! আপনারা সা‘দ সাহেবের যেসমস্ত ভুলের কথা বলেন, তার একটাও আমাদের মধ্যে নেই। আমি বললাম, এই যে দাবি করছেন-আপনাদের মধ্যে সে ভুলগুলো নেই, কিন্তু আপনি কী জানেন সা‘দ সাহেবের ভুল সম্পর্কে? সা‘দ সাহেবের কয়টা গোমরাহীর কথা আপনার জানা আছে? আপনি নিজেও ওসব কথা বলেন, অথচ আপনার খবরও নেই।

আপনি যে দাবি করছেন-আপনাদের মধ্যে সেগুলো নেই, সেই বিচার পরে, কিন্তু যে কয়টি গোমরাহীর আলোচনা আপনারা সাধারণত শুনে থাকেন সেগুলো ছাড়াও তার আরও গোমরাহী আছে কি না? আছে। তাছাড়া আমাদের এতাআতী ভাইয়েরা তো দিন দিন নিত্য নতুন গোমরাহী আবিষ্কার করেই যাচ্ছেন! কিছু তো সেখান (দিল্লি) থেকে আসে। আর কিছু তারা নিজেরাও আবিষ্কার করেন। আরে, এখন তো তর্কও করে আলেমদের সাথে। বলে, ‘আমরাও ছয় নম্বরের মেহনত করি, আপনারাও ছয়নম্বরের মেহনত করেন; তাহলে সমস্যা কোথায়?’ আহারে! কোনো সমস্যাই যদি না থাকে তো আপনি ভিন্ন কেন? শূরায়ী নেযামের ভাইয়েরা ভিন্ন হয়েছেন, নাকি এতাআতীরা? আপনি আমাদের এই দেশেই লক্ষ্য করুন! এখানে কি শূরায়ী নেযামের ভাইয়েরা ভিন্ন হয়েছেন, নাকি সা‘দপন্থীরা? সা‘দপন্থীরাই ভিন্ন হয়েছেন। জোড়ের সময় তো তাদেরই কেউ কেউ মাঠ থেকে বের হয়ে গেছেন। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরের জোড়ে মাঠ থেকে তারা বের হয়ে গিয়েছিলেন। কেউ কেউ বের হয়ে ফোন করে অন্যদের বের করার চেষ্টা করেছিলেন। এরপর তারা ইজতিমা ত্যাগ করলেন। পরে আবার মাঠ দখলের জন্য সবাইকে পাইকারিভাবে মারধোর করল। কারো মাথা ফাটাল, কারো হাত ভাঙ্গল, কারো পা ভাঙ্গল।

অথচ তারা বলছেন, সমস্যা কোথায়? সমস্যা নাকি এখনও বুঝিয়ে দিতে হবে! আমাদের হযরতপুর এলাকায় এক এতাআতী ভাই আছেন। তিনি মানুষকে তাশকীল করেন-ওইদিকে যাবে না, আমাদের সাথে এসো। আমাদের মাদরাসার ছাত্ররা এলাকায় গাশত করে জামাত তৈরি করে আসে, আর পেছন দিয়ে তিনি এসে তাশকীল করে সেই জামাতকে নিজেদের সাথে নিয়ে যান। বলেন, তাদের সাথে যাবে না, আমাদের সাথে চল! বিভিন্ন যুক্তি দেন। তার কিছু বক্তব্য শুনুন- ‘আরে, আলেমরা না-হয় একশ মাসআলা জানে, আমি পঞ্চাশটা হলেও তো জানি!’ মানে তুমি আলেমদের সাথে থাকতে বলছ, আমিও তো আলেম!

এবার বলুন, একজন জাহেল-মূর্খ; সে মানুষকে দাওয়াত দিচ্ছে-আলেমদের সাথে যাওয়ার দরকার নেই, আমার সঙ্গে এসো। আলেমদের তত্ত্বাবধানে তাবলীগের কাজ করতে হবে না, আমার সঙ্গে থাক। আলেমরা না-হয় একশ মাসআলা জানে, আমি পঞ্চাশটা হলেও তো জানি! এগুলো গোমরাহীর কথা, নাকি হেদায়েতের কথা? গোমরাহীর কথা।

আপনারা দশ-পনের বছর আগের তাবলীগের কথা স্মরণ করুন; বরং পাঁচ বছর আগের তাবলীগের কথাও মনে করুন! তখন সাধারণ মানুষ আলেমদের কাছে গিয়ে তর্ক করত, নাকি দুআর জন্য যেত? দুআর জন্য যেত। কিন্তু এখন তর্ক করে কি না? করে। আমার সঙ্গে করে আমাদের এলাকার এতাআতী! আমি তো ছোট্ট-খাট্ট একজন মৌলভী। বড় হুজুর যারা আছেন, তাঁদের সাথেও তর্ক করে! তুমি সাধারণ মানুষ হয়ে তর্ক করছ আলেমদের সাথে! কোনটা হক, কোনটা না-হক, কোনটা হেদায়েত, কোনটা গোমরাহী সেক্ষেত্রে আলেম বলেন একটা, তুমি বল আরেকটা! আলেমদের বিপরীতে অবস্থান নিচ্ছ! তোমার গোমরাহী সাব্যস্ত হওয়ার জন্য এরচে বড় দলীলের দরকার আছে কি? এই দেশের এতাআতীদের গোমরাহী প্রমাণ হওয়ার জন্য এরচে বড় দলীল আর কী দরকার? আলেমরা বলেন একটা, তারা বলে আরেকটা! নিজেদেরকে আলেমদের প্রতিপক্ষ বানাচ্ছে, এরপরও তারা নিজেদের গোমরাহির দলীল খুঁজে পায় না!

আরও ঘটনা শুনুন! আমি একেবারে নামসহ বলতে পারব-ইনশাআল্লাহ। এখন নাম বলব না। প্রয়োজনও নেই। কিন্তু কেউ যদি অস্বীকার করে, তাহলে প্রয়োজনে নাম-ঠিকানাসহ বলে দেব-ইনশাআল্লাহ। তিন চিল্লার সাথী। মুরগির ব্যবসা করে। একেবারেই সাধারণ লোক। শূরায়ী নেযামের এক ভাই তাকে বললেন,তুমি এতাআতী হয়ে গেলে, এ কেমন কথা! কাজ তো আলেমদের তত্ত্বাবধানে হওয়া দরকার। সে উত্তর দিয়েছে। ‘আলেম কে? আলেম বলা হয়, যে আল্লাহকে ভয় করে; আমিও আল্লাহকে ভয় করি, আমিও আলেম!’ এখন আপনিই বলুন, যাদের চিন্তাধারা এই, তারা কি ইলিয়াস রাহ.-এর তাবলীগের উপর আছে?

আরেকজনের কথা শুনুন! তাকে একটা প্রশ্ন করা হয়েছিল, সেই প্রশ্নের উত্তরে সে বলেছে, ‘আরে না, আলেমদেরকে মাঝে মাঝে পিটাতে হয়। নাহলে ঠিক হয় না।’ তারা এরূপ কথাবার্তা, আচার-আচরণ, মিথ্যাচার ও গালমন্দ করেই যাচ্ছে! ইলম ও আহলে ইলমের বিপরীতে অবস্থান করেই যাচ্ছে! আর সরলমনা মানুষকে ধোঁকা দিয়ে দিয়ে নিজেদের দল ভারী করছে! রীতিমতো মিথ্যাচার করে যাচ্ছে, এরপরও তারা নিজেদের গোমরাহী খুঁজে পায় না! বলে, আমরাও তো ছয় নম্বরের বয়ান করি, আমরা তো একই কথা বলি!’

আচ্ছা, তাদের প্রতি প্রশ্ন-আপনারা ইলম ও যিকিরের যে ইলম, সেটা কি ওই মুরগিঅলা থেকে নিবেন? কারণ তার কথায় সেও তো আলেম।

ইলম ও যিকিরের মধ্যে শেখানো হয়, ফাযায়েলের ইলম তালীমের হালকা থেকে শিখব আর মাসায়েলের ইলম হক্কানী আলেমদের থেকে শিখব। আপনি তো মাসআলা শিখবেন সেই মুরগি ব্যবসায়ী থেকে! আর না হয় আমাদের হযরতপুরের ওই এতাআতী ভাই থেকে, যিনি বলেছেন, আলেমরা একশ মাসআলা জেনে থাকলে তিনি পঞ্চাশটা হলেও জানেন!

এখন সামনে থেকে তো আর বলতে পারবেন না, মাসায়েলের ইলম আলেমদের কাছে! বললে মিথ্যা হবে। তারা তো আলেমদের গুরুত্ব দিচ্ছেন না, এখন তাদের ছয় নম্বরে যে ইলমের কথা রয়েছে, তার কী ব্যাখ্যা তারা করবেন? তারা তো আলেমদের কাছে শিখো, এটা বলতে পারবেন না। বললে মিথ্যা হবে! কারণ তারা আলেমদের ফতওয়া অবজ্ঞা করছেন। দারুল উলূম দেওবন্দের ফতোয়া অবজ্ঞা করছেন, আবার তার উল্টো ব্যাখ্যাও করছেন!

তারা দারুল ঊলূম দেওবন্দের ফতোয়া কাটছাঁট করেছেন

তারা দারুল উলূম দেওবন্দের ফতোয়াকে কাটছাঁট করে বাংলা অনুবাদ করে এদেশে ছড়াচ্ছেন। অথচ দারুল উলূম দেওবন্দ মাওলানা সা‘দ সাহেব সম্পর্কে যে অবস্থান ব্যক্ত করেছে, সে অবস্থান থেকে দারুল উলূম একটুও সরেনি। এখনও পুরো অটল। কারণ এখনও সা‘দ সাহেবের পরিবর্তন নেই। তাহলে ফতোয়ার পরিবর্তন হবে কেন? ফতোয়া তো একটা প্রেক্ষিতে হয়েছে। ফতোয়ায় মাওলানা সা‘দ সাহেব সম্পর্কে বলা হয়েছিল, তিনি ‘ফিকরি বে-রাহরবী’ তথা চিন্তাগত বিপথগামিতার শিকার; তিনি গলত ইসতেদলাল, অর্থাৎ কুরআন-হাদীস দ্বারা যেটা প্রমাণ হয় না, জোর-জবরদস্তি করে সেখান থেকে সেটা প্রমাণ করার অপচেষ্টা করেন। আর নিজে তাবলীগের যে কাঠামো ও রূপরেখা তৈরি করেছেন, কুরআন হাদীসের যত জায়গায় দাওয়াতের কথা আছে, সবগুলোকে নিজের তৈরিকৃত দাওয়াতের রূপরেখার উপর প্রয়োগ করেন; বরং এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে দেন। মানে, এর বাইরে আর কোনো দাওয়াত হতে পারে না-নাউযুবিল্লাহ। এর বাইরে হযরত মাওলানা ইবরাহীম দেওলা সাহেব যেটা করছেন সেটাও দাওয়াত নয়। মাওলানা যোবায়ের সাহেব যেটা করছেন সেটাও দাওয়াত নয়; বরং উনি যেটা বুঝছেন এবং করছেন, সেটাই কেবল দাওয়াত-নাউযুবিল্লাহ।

দারুল উলূম দেওবন্দ একেবারে সর্বশেষ লেখায় যেটা বলেছে সেটা হল, দেওবন্দ আগে যা বলেছে, এখনও সেটার উপর আছে। সেটা কী, অনেক পৃষ্ঠার ফতোয়ার সারসংক্ষেপ আবার এক পৃষ্ঠায় বলে দিয়েছে। সা‘দ সাহেবের মূল সমস্যাটা হল ‘ফিকরি বে-রাহরবী’, ‘গলত ইসতেদলালাত এবং মুজতাহিদসুলভ আচরণ। সেগুলো আপন জায়গায় বহাল আছে। কারণ এখনও তার বয়ানে তিনটা জিনিসই ব্যাপকভাবে পাওয়া যাচ্ছে।

এক. মুজতাহিদসুলভ আচরণ। অথচ কোথায় ইজতিহাদের স্তর আর কোথায় মাওলানা সা‘দ সাহেব! ইলমের পরিপক্কতা না থাকা সত্ত্বেও তিনি মুজতাহিদসুলভ কথাবার্তা বলেন এবং বয়ান করেন।

দুই. গলত ইসতেদলাল-দলীলের ভুল প্রয়োগ এবং অপপ্রয়োগ।

তিন. গলত তাতবীক। অর্থাৎ কুরআন সুন্নাহ্র মধ্যে দাওয়াতকে যে ব্যাপক অর্থে বলা হয়েছে, তিনি সে নুসূসগুলোকে নিজের তৈরি করা দাওয়াতের একটা সীমাবদ্ধ পদ্ধতি, যার মধ্যে নিজের থেকে আরও অনেক বেদআত ঢুকিয়েছেন, অনেক গলত কথা ঢুকিয়েছেন, সেই সীমাবদ্ধ দাওয়াতের উপর কুরআন-সুন্নাহ্র সমস্ত নুসূসকে প্রয়োগ করা এবং বোঝানো যে, এটাই সেটা; বরং এটাই একমাত্র উদ্দেশ্য-নাউযুবিল্লাহ।

প্রশ্ন হল, এই কাজগুলো কি তিনি বন্ধ করেছেন? করেননি। পুরনোগুলো তো আছেই, নতুন যত বয়ান করছেন, অর্থাৎ ৩১ জানুয়ারি ২০১৮ ঈসায়ীতে প্রকাশিত মাওলানা সা‘দ সাহেব সম্পর্কে দারুল উলূম দেওবন্দের সর্বশেষ বক্তব্যের পর থেকে ২০২০ এর মার্চ পর্যন্ত (এরপর তো তিনি গায়েব হয়ে গেলেন। এখন শোনা যাচ্ছে, তিনি যাকিরনগরে কিছু কিছু মজলিস করছেন)-এই সময়ের মধ্যে তিনি যত বয়ান করেছেন সেগুলোতে এই মৌলিক তিন সমস্যা বিদ্যমান।

কিন্তু এগুলো সাধারণ মানুষ বুঝবে কোত্থেকে? সাধারণ মৌলভী সাহেবরাও এগুলো ধরতে পারার কথা নয়। এগুলো বিজ্ঞ আলেমদের বোঝার বিষয়। কিন্তু এতাআতী ভাইয়েরা বলে, আমরা নিযামুদ্দিন ঘুরে এসেছি, কই, কোনো সমস্যা নেই! ডাক্তার বলছে, রোগীর হার্টের সমস্যা। কিন্তু রোগী সাধারণ মানুষ; সে বলছে, কই, আমি তো কোনো সমস্যা দেখছি না!

এই যে, তারা বলছে, ‘আমি নেযামুদ্দিন গিয়েছি; কই, কোনো সমস্যা নেই’, এর অর্থ, তারা দাবি করছে-তারাও বোঝে! আলেমদের বলতে চাচ্ছে, সমস্যা আছে কি না-সেটা তারাই নির্ণয় করতে পারে। কেমন যেন ডাক্তার না হয়েও ডাক্তার হওয়ার দাবি! দ্বীনী বিষয়ে বিশেষজ্ঞ না হয়েও বিশেষজ্ঞ হওয়ার দাবি করা, এটা কি হেদায়েত না গোমরাহী? গোমরাহী। তারপরও নাকি এতাআতী ভাইয়েরা তাদের সমস্যা খুঁজে পান না! আরে, এত দূরে যাওয়ার দরকার নেই, কেবল তাদের নীতিগুলো দেখলেই আপনি বুঝতে পারবেন।

ইসতেকামাত থাকতে হবে সহীহ তরীকার কাজের উপর

ভাইয়েরা! শুরুতে আমি ইসতেকামাতের কথা বলেছিলাম। প্রশ্ন হল, ইসতেকামাত গলত তরীকার কাজে হয়, নাকি সহীহ তরিকার কাজে? সহীহ তরিকার কাজে। সেজন্য গলত তরীকায় যারা আছে তাদের কর্তব্য হল সহীহ তরীকায় ফিরে আসা। আর যারা সহীহ তরীকায় আছে তাদের কর্তব্য হল গুরুত্বের সঙ্গে উসূল মোতাবেক কাজে লেগে থাকা। মনে রাখবেন, অনেক কাজ এমন আছে যে, মুসতহাব হওয়া সত্ত্বেও অবস্থার প্রেক্ষিতে সেগুলোর গুরুত্ব বেড়ে যায়। যেমন দান-সদকা করা। মুসতাহাব আমল। কিন্তু যখন দেখছি, আমার একেবারে পড়শি-প্রতিবেশী ক্ষুধায় মরে যাচ্ছে তখনও কি মুসতাহাব? তখন তো নগদ তার খবর নিতে হয় এবং পাশে দাঁড়াতে হয়। এরকম অনেক বিষয় আছে, যেগুলো বিধানগতভাবে মুসতাহাব, কিন্তু অবস্থার প্রেক্ষিতে কখনো সেগুলোর গুরুত্ব অনেক বেড়ে যায়। মুসতাহাব মনে করে যদি অবহেলা করা হয় তাহলে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যায়। এখন আমাদের এই পাঁচকাজের ঠিক এই দশা চলছে। চিল্লা, মাসে তিনদিন, গাশতসহ পাঁচকাজ যদিও মুসতাহাব বরং মুসতাহসান, কিন্তু অবস্থার কারণে এগুলো এখন আমাদের প্রতি অনেক বেশি গুরুত্বের দাবি রাখে। কারণ যদি আপনার মহল্লায় কাজ দুর্বল হয় তো এতাআতীরা এখানে দখল দেবে। তারা কি আর বসে আছে?

তারা কিন্তু বসে নেই। তারা অনেক তৎপর। যদিও তাদের এত তৎপর হওয়াটা আশ্চর্যের বিষয় নয়। কারণ মানুষের পিছনে নফস আর শয়তান লেগে থাকে তো। তারা বুদ্ধি করে কাজ করে। কাকে ঢিলা রাখতে হবে আর কাকে চাঙ্গা করে রাখতে হবে, সেটা শয়তানের ভালোই জানা আছে। যে গলত রাস্তায় আছে তাকে চাঙ্গা করে দেয়। আর যে সহীহ রাস্তায় তাকে দুর্বল করে দেয়। কারণ যে ব্যক্তি সহীহ রাস্তায় সে বসে থাকলেই শয়তানের ফায়দা। এজন্য ছোট ছোট অজুহাতে মনের মধ্যে প্ররোচনা দেয়, থাক! আজকে যেয়ো না তালীমে! আজকে মশওয়ারাতে যেয়ো না! আজকে শবগুযারিতে যেয়ো না! এই মাসে তিনদিনে যাওয়ার দরকার নেই। তোমার তো এই এই ঝামেলা আছে। নতুন নতুন ঝামেলা মনে করিয়ে দেয়। এভাবে মহল্লার কিছু সাথী যখন ঢিলা হবে, তখন নতুন সাথী যারা যুক্ত হওয়ার, তারা ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় কোন্ দিকে ঝুঁকবে?

আমার শেষ কথা, আমাদের আরও চাঙ্গা হতে হবে। গলত রাস্তায় গিয়ে তারা যদি চাঙ্গা হতে পারে, আমরা যারা হক রাস্তায় আছি, আমাদের আরও বেশি চাঙ্গা হতে হবে। কীভাবে চাঙ্গা হব? পাঁচ কাজের গুরুত্ব বাড়াব। যেখানে যেখানে কাজ দুর্বল সেখানে কাজ মজবুত করার চেষ্টা করব।

আজকে শুনলাম, এদিকে এক মসজিদে কাজ দুর্বল ছিল, শূরায়ী নেযামের কোনো কাজ ছিল না। সেজন্য কিছু সাথী যখন কাজ শুরু করেছেন, তাদের হুমকি-ধমকি দেয়া হচ্ছে। তাদের খুব পেরেশান করা হচ্ছে। ভয়ে তারা কাজ ছেড়ে দেন কি না-এমন আশংকা হচ্ছে এখন! দুআ করুন, আল্লাহ যেন তাদেরকে ইসতেকামাত দান করেন-আমীন।

ভাই! ভয় করবেন শুধু আল্লাহকে। শূরায়ী নেযামের সাথীরা যদি ভয়ে কাজ ছেড়ে দেন, তাহলে কেমন হবে বিষয়টা! ঈমান শেখার বিষয়ে আমরা একটা কথা বলি (যদিও এখানে কথা আছে অনেকগুলো, কিন্তু আমরা প্রাথমিকভাবে একটা শিখি)। সেটা হল, ‘মাখলুকের ইয়াকীন দিল থেকে সরাতে হবে। আল্লাহ্র ইয়াকীন দিলে বসাতে হবে। কিছু থেকে কিছু হয় না, যা হয় সব আল্লাহ্র হুকুমেই হয়।’ ছয় নম্বরের প্রথম হল কালিমা। কালিমার আলোচনায় আমরা এটা বলি কি না? বলি এবং আরো বলি, ‘দুনিয়ার সবাই যদি একসাথ হয়েও আমার ক্ষতি করতে চায়, কিছুই করতে পারবে না, যদি আল্লাহ্র হুকুম না হয়। তদ্রƒপ সবাই যদি একসাথ হয়ে আমার কোনো উপকার করতে চায়, কোনো উপকার করতে পারবে না, যদি আল্লাহর হুকুম না হয়?

এখন এত চিল্লার পরে, এত গাশত ও বয়ানের পরেও যদি ভয়ে দ্বীনের কাজ ছেড়ে দিতে হয় তাহলে বুঝুন, আমরা কী শিখেছি? কাজেই কারো ভয়ে আমরা কাজ ছাড়তে পারি না। যেখানে তারা আল্লাহ্র নাফরমানি করে গলত রাস্তায় থেকেও কাজ ছাড়ে না, সেখানে আপনি সহীহ রাস্তায় কাজ করছেন, সুন্নত তরীকায় কাজ করছেন, তাহলে আপনি কেন মাখলুকের হুমকি-ধমকির ভয়ে কাজ ছেড়ে দেবেন? এজন্য ভাই! আল্লাহ্র উপর ভরসা করে কাজকে মজবুতভাবে ধরুন, আল্লাহ সাহায্য করবেন-ইনশাআল্লাহ।

আমরা ভয়ে যেমন কাজ ছাড়ব না, বিরক্ত হয়েও কাজ ছাড়ব না। কেউ বলে, তাবলীগে এত দ্বন্দ্ব! আর তাবলীগে যাওয়ার দরকার নেই। আর পারব না চিল্লায় যেতে। আর পারব না পাঁচকাজ করতে। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন!

হালাত দেখে যারা হাত-পা গুটিয়ে নেয়, তারা কি সমঝদার, না বোকা? বোকা। হালাত আসে পরীক্ষার জন্য। হালাত দিয়ে আল্লাহ তাআলা মুমিনকে আরও চাঙ্গা করতে চান। কারণ মুমিন তখন ভাববে, নিশ্চয়ই আমার কাজ সুন্দরমতো হয়নি। উসূল মাফিক হয়নি। নিশ্চয়ই আমার কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়ে গেছে। আল্লাহ! তুমি ক্ষমা করে দাও! আমি সামনে আরও ভালোভাবে ও সুন্দরভাবে করব। আল্লাহ, তুমি হালাত ঠিক করে দাও!

اللّهُمّ أَلِّفْ بَيْنَ قُلُوبِنَا، وَأَصْلِحْ ذَاتَ بَيْنِنَا، وَاهْدِنَا سُبُلَ السّلَامِ، وَنَجِّنَا مِنَ الظّلُمَاتِ إِلَى النّورِ، وَجَنِّبْنَا الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ.

 (হে আল্লাহ! আমাদের অন্তরে প্রীতির সঞ্চার করুন এবং পরস্পরের সম্পর্ক সদ্ভাবপূর্ণ করুন। আমাদের সম্মুখে শান্তি ও নিরাপত্তার পথসমূহ খুলে দিন এবং সকল অন্ধকার থেকে মুক্ত করে এক আলোর দিকে পরিচালিত করুন। আমাদের দূরে রাখুন প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য অশ্লীলতা ও গর্হিত কর্ম থেকে।)

মুমিন এভাবে আল্লাহ্র দরবারে দুআ করবে। তাঁর উপর ভরসা রাখবে। তাঁর সাহায্য অবশ্যই আসবে। সুতরাং কারো ভয়ে আমরা কাজ ছাড়ব না। তবে কারো সাথে খারাপ আচরণও করব না। কাউকে গালমন্দ করব না। কেউ আমার গায়ে হাত তুললে আমি তার গায়ে হাত তুলব না। আদম আলাইহিস সালামের দুই সন্তানের ঘটনা কুরআনে আছে। কার কী নাম, সেটা কুরআনে নেই। কিন্তু ইতিহাসে পাওয়া যায়, একজনের নাম হাবিল, আরেক জনের নাম কাবিল। তাদের মধ্যে একজন জুলুম করে আরেক জনকে হত্যা করে দিয়েছে। কিন্তু যিনি সঠিক রাস্তায় ছিলেন, তিনি বলেছিলেন, তুমি আমার গায়ে হাত ওঠাতে পার, কিন্তু আমি তোমার গায়ে হাত ওঠাব না। তুমি যদি গোনাহ করতেই চাও, সেটা তোমার কাঁধে। আমি এতে জড়াতে চাই না। আমি সবর করব।

তারা ছয়নম্বরের শিরোনাম ব্যবহারের অধিকার রাখেন না

আমাদের এতাআতী ভাইয়েরা যেন নীতিই বানিয়ে নিয়েছে, আলেমদের মারতে হবে। আলেম মানে শুধু আলেম নয়, বরং তাঁদের সাথে যারা আছে সবাইকে। মাঠে কি তারা কেবল মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের মেরেছে, না সাধারণ দ্বীনদার মুসল্লিদেরও মেরেছে? সবাইকেই মেরেছে। কিন্তু আমাদের নীতি হবে সঠিক অর্থে ইকরামুল মুসলিমীন।

আপনি কি মনে করছেন, আমাদের ছয়নম্বর আর তাদের ছয়নম্বর এক? কখনো নয়। তাদের তো এখন আর এগুলো উচ্চারণ করা বা ব্যবহার করার অধিকার নেই। তারা খামোখা এগুলো ব্যবহার করছে! তারা ছয়নম্বরের নাম ব্যবহার করে, কিন্তু ব্যাখ্যা দেয় অন্যটা। ব্যাখ্যা যদি ভিন্ন না হত, তাহলে আপনিই বলুন, তাবলীগের ইকরামুল মুসলিমীনের আলোচনায় আপনি কি যিন্দেগীতে শুনেছেন, আলেমদের পেটাতে হবে? তাহলে তারা কেন ইকরামুল মুসলিমীন নাম ব্যবহার করছে? আগে আমরা ইকরামুল মুসলিমীনের বয়ানে এই হাদীস শুনতাম-

لَيْسَ مِنْ أُمَّتِي مَنْ لَمْ يُجِلّ كَبِيرَنَا، وَيَرْحَمْ صَغِيرَنَا، وَيَعْرِفْ لِعَالِمِنَا.

ওই লোক আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়, যে আমাদের বড়কে সম্মান করে না, আমাদের ছোটকে দয়া করে না এবং আমাদের আলেমের হক জানে না। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২২৭৫৫; শরহু মুশকিলিল আসার, তহাবী, হাদীস ১৩২৮

(قال الهيثمي في "مجمع الزوائد" 8 :13 : إسناده حسن)

বড়দের সম্মান করা, ছোটদের স্নেহ করা এবং আলেমের হক জানা ও তাযীম করা। তাযীম করা মানে কি শুধু সম্মান করা? হাদিয়া নিয়ে যাওয়া? না। বরং তাযীমের প্রথম সূরত তো হল আলেমগণ কুরআন-সুন্নাহ্র আলোকে যা বলবেন, তার অনুসরণ করা। তারা কুরআন-সুন্নাহ্র ইলমের ভিত্তিতে যা বলবেন তা মান্য করা। কেবল সম্মান করলেই তো হবে না।

এখন এতাআতী ভাইয়েরা ইকরামুল মুসলিমীন প্রসঙ্গে কী বলবেন? বলা হয়েছে, ‘হার মুমিনের কীমত বুঝে তার কদর করা। সকল মুসলিমের ইকরাম করা’। কিন্তু এতাআতীরা বলবেন, আলেমদের এবং শূরায়ী নেযামওয়ালাদের ইকরাম করা যাবে না। তাদেরকে সুযোগ পেলেই ‘শায়েস্তা’ করতে হবে। একহাত দেখে নিতে হবে। এটা মুখে না বললেও তাদের আচার-আচরণ কিন্তু এটাই প্রমাণ করে। আর ওই এতাআতী ভাইয়ের কথা তো শুনালামই। সে বলেছে, আলেমদের পেটাতে হয়। অথচ ইকরামুল মুসলিমীনের মধ্যে আলেমের ইকরাম-সম্মানের কথা আছে কি না? আছে। তাহলে যারা বলে, আলেমদের পেটাতে হয়, তাদের ছয়নম্বরের মধ্যে যে ইকরামুল মুসলিমীন আছে, সেটা কি আগের ইকরামুল মুসলিমীন? কখনো নয়। ইলিয়াস রাহ.-এর তাবলীগের ইকরামুল মুসলিমীন? কখনোই নয়। রাসূলুল্লাহর সুন্নতে যে ইকরামুল মুসলিমীন, এটা কি সেটা? কখনো নয়। এভাবে একটা একটা করে যখন আপনি বিশ্লেষণ করবেন, দেখবেন এতাআতী বা সা‘দপন্থীদের ছয় সিফাতের মধ্যে যে ছয়নম্বর, তার প্রত্যেকটার মধ্যে নতুন নতুন ব্যাখ্যা। চাই মুখে বলুক আর নাই বলুক, কিন্তু তাদের আচার-আচরণে এবং নীতিতে নতুন নতুন ব্যাখ্যা এসে গেছে। এখন তারা যে ছয়নম্বরের তাবলীগ করছেন, সেটাকে মূলধারার তাবলীগ বলা তো একেবারে মিথ্যাচার! ছয়নম্বরের ছয় সিফাতের শিরোনাম ব্যবহার করাটাও ডাহা মিথ্যাচার। এটা করতে গেলেই তারা মিথ্যাচারের মধ্যে পড়ে যাবেন। অজান্তে হলেও মিথ্যাচারে লিপ্ত হয়ে যাবেন। কারণ এই ছয়নম্বরের সঠিক ব্যাখ্যা রেখে তাদের নীতি ও আচরণের সাথে তা মেলাতে পারবেন না। বিষয়গুলো একেবারে স্পষ্ট। এজন্য কোনো ধোঁকার মধ্যে যেন আমরা না পড়ি। তাবলীগ তো করব আখেরাতের জন্য। যাতে আখেরাতে গিয়ে সেটা হাজির পাই। আমি হাজারো চিল্লা লাগালাম, কিন্তু আকীদা আমার আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর তরীকা ও ব্যাখ্যা মোতাবেক নেই। আকীদায় সা‘দ সাহেবের গোমরাহী ঢুকে গেল বা অন্য কোনো গোমরাহী ঢুকে গেল, তাহলে এই তাবলীগ আখেরাতে কাজে আসবে না। ভাই! আকীদা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে সহীহ আকীদার উপর থাকার তাওফীক নসীব করুন।

ছয়নম্বরের প্রথমটা হল কালিমা। আকীদায় সমস্যা মানে কালিমার মেহনত যথাযথ হচ্ছে না। সেজন্য এতাআতী ভাইয়েরা যতক্ষণ পর্যন্ত নিজেদের আকীদা ঠিক না করবেন, তারা কালিমার দাওয়াত কীভাবে দেবেন? শূরায়ী নেযামের ভাইয়েরা তো নীতি বানিয়ে নিয়েছেন, আমরা সহীহ তরিকায় থাকতে চাই। বাকি অজান্তে আমাদেরও ভুল আছে। অনেক ভুল কথা শুনেছি, মাথায় বসে আছে, সেগুলো আস্তে আস্তে বের করতে হবে এবং সংশোধন করতে হবে। সেজন্যই ইলম ও যিকিরের প্রতি গুরুত্ব প্রদান।

চিল্লা থেকে ফিরে চিল্লার শিক্ষা ধরে রাখি

চিল্লা থেকে ফিরে আসার পর পাঁচকাজ তো আছেই, সাথে আরও কিছু কাজ আছে। পাঁচকাজ তো চিল্লার অংশ। মানে চিল্লা শেষ হয়েছে বটে, কিন্তু চিল্লার কাজ শেষ হয়নি। এই পাঁচকাজ দিয়ে কেমন যেন আমি চিল্লাটা জারি রাখলাম। এজন্য এই পাঁচকাজ আমাকে করতেই হবে, কিন্তু এর বাইরে আরও কাজ আছে। আমি আগেও আলোচনা করেছিলাম। আমাদের সমস্যা হল, যেটা চিল্লাতে বলে আসি সেটা বাড়িতে এসে ভুলে যাই।

চিল্লা থেকে ফেরার পর আমাকে দ্বীন-দুনিয়ার সকল কাজে আগের চেয়ে আরও বেশি চাঙ্গা হতে হবে। স্কুল-কলেজের ছাত্র হলে চিল্লা থেকে আসার পর তার পড়াশোনা, আচার-আচরণ আগের চেয়ে ভালো হতে হবে। শিক্ষকের সাথে আচরণ, বাবা-মায়ের সাথে আচরণ আগের চেয়ে ভালো হতে হবে। সহপাঠীদের সাথেও আচরণ আগের চেয়ে ভালো হতে হবে।

দোকানদার চিল্লায় গেলে, চিল্লা থেকে ফেরার পর তার দোকানদারি আগের চেয়ে আরও মজবুত হতে হবে। দোকান যখন খোলার তখনই খুলবে, যখন বন্ধ করার তখন বন্ধ করবে। হাঁ, কোনো দিন নগদ কোনো দ্বীনী তাকাযা এসেছে; সেই তাকাযা পূরণের জন্য কোনো দিন ব্যতিক্রম হলে ভিন্ন কথা। কিন্তু এই ধারণা করা যে, ধুর! দোকান-টোকান এসব তো দুনিয়া! কাজেই খুললে খুললাম, না খুললে না খুললাম। এই ধরনের চিন্তা-ভাবনা থেকে যদি দোকানদারিতে অবহেলা করে, তাহলে এই লোকের চিল্লা কি সফল, না বিফল? পুরোটাই বিফল। চিল্লা যদি সফল হত তাহলে তার দুনিয়া বলতে কিছু থাকত না। আরে, মুমিনের দুনিয়া তো দ্বীনের অধীন। মুমিনের কোনো দুনিয়া নেই। তার সবই দ্বীন। মুমিন যদি তার দুনিয়াকে দ্বীন না বানাতে পারল, তাহলে তার চিল্লা, হজ্ব বা কোনো আল্লাহওয়ালার সাথে সম্পর্ক-কিছুই কামিয়াব হল না। মুমিনের দোকান কার জন্য? আল্লাহ্র জন্য। দোকানদারি হবে রাসূলের তরীকা মতো। সেখানে মানুষকে ধোঁকা দেয়া হবে না। ওজনে কম দেয়া হবে না। মিথ্যা বলা হবে না। সুদ যুক্ত হবে না। ব্যস, হালাল ব্যবসা হয়ে গেল। হাদীসে আছে-

التّاجِرُ الصّدُوقُ الأَمِينُ مَعَ النّبِيِّينَ، وَالصِّدِّيقِينَ، وَالشّهَدَاءِ.

অর্থাৎ সততা, সত্যবাদিতা ও আমানতদারিতা আছে, এমন ব্যবসায়ীদের হাশর হবে নবীদের সাথে, সিদ্দীকীনের সাথে এবং শহীদদের সাথে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১২০৯

(قال الترمذي : هذا حديث حسن)

তাহলে আপনার দোকানদারি কি দুনিয়া, না দ্বীন? দ্বীন। চিল্লা লাগানোর পরও যদি আপনি দোকানদারিকে দ্বীনের অধীনে না আনতে পারেন, আখেরাতের জন্য না বানাতে পারেন, তাহলে কি চিল্লা সফল হল? আর যদি আপনার দোকানদারি আখেরাতের জন্যই হয়ে থাকে তাহলে কি আপনি অবহেলা করে দোকান দেরিতে খুলতে পারেন? না। কাজেই আপনাকে দ্বীন-দুনিয়ার সবকিছুতে চাঙ্গা হয়ে যেতে হবে।

অফিসে চাকরি করি। আগে অফিসে যেতাম দেরি করে। চিল্লা থেকে এসে, এখন আমাকে অফিসে যেতে হবে একেবারে সময়মতো। অফিস থেকে বেরও হব সময়মতো। নাকি উল্টো করব যে, আমাকে যেহেতু গাশত করতে হবে তাই একটু আগে বের হয়ে যাই? জায়েয হবে? কখনো নয়। কারণ আপনার ডিউটি যদি হয় ছয় ঘণ্টা, অফিসের ডিউটি বাদ দিয়ে সেখান থেকে গাশতের জন্য সময় খরচ করা কি আপনার জন্য জায়েয হবে? না। হাঁ, আপনার যদি তাকাযা থাকে, আপনি ছুটি নিন। আধ ঘণ্টা বা এক ঘণ্টা আগে যদি বেরোতে হয় আপনি ছুটি নিয়ে বেরোন। ছুটি না নিয়ে নিজের ইচ্ছেমতো বেরোলে এই গাশতের কোনো সওয়াব হবে না। আর ডিউটি বাদ নিয়ে অনুমতি না নিয়ে বের হওয়ার গোনাহ তো আছেই।

আগে জামাতে ঠিকমতো আসতাম না। এক ওয়াক্তে আসলে আরেক ওয়াক্তে আসতাম না। কিন্তু চিল্লা থেকে ফেরার পর এখন এক ওয়াক্ত জামাতও ছোটে না। বিশেষ ঠেকা ও ওজর ছাড়া এখন সব নামায মসজিদে গিয়ে জামাতের সাথে আদায় করি। মানে-দ্বীন-দুনিয়ার সকল কাজে এখন আমি চাঙ্গা।

চিল্লা থেকে ফেরার পর আরেক কাজ হল, চিল্লায় থাকা অবস্থায় যেটা বয়ান করেছিলাম এবং যেটার বয়ান শুনেছিলাম সেটা হল, ছয়নম্বর। সেখানে একটা আছে ইলম ও যিকির। বলেছি, ফাযায়েলের ইলম তালীমের হালকা থেকে শিখব। মাসায়েলের ইলম আলেমদের কাছে শিখব। তাহলে আমাকে এখন আলেমদের কাছে যেতে হবে কি না? অবশ্যই। অতএব চিল্লা থেকে আসার পর ফরযে আইনের ইলম শেখার জন্য আলেমদের কাছে আসব। মাদরাসায় বা মসজিদে, যেখানেই ইলম শেখানো হয়, কুরআনের মশক হয়, নামাযের মশক হয়, হালাল-হারাম জানানো হয়, দ্বীনের আহকাম জানানো হয়, সেখানে আমি ভর্তি বা যুক্ত হয়ে যাব। বলতে পারেন, হুজুর! সপ্তাহে সাত দিন আসতে পারব না, পাঁচ দিন আসব। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মাত্র এক ঘণ্টার জন্য আসব, আধা ঘণ্টার জন্য আসব। আমাদেরকে পড়ার ব্যবস্থা করে দিন। এরপর আবার আমার চিল্লার সময় হলে আমি চিল্লায় চলে যাব, আমাকে ছুটি দিতে হবে। সব ঠিক আছে, আপনার যত শর্ত লাগানো দরকার, লাগান, তারপরও আসুন।

ইলিয়াস রাহ. কিন্তু মেহনত এজন্যই শুরু করেছিলেন। চিল্লা থেকে এসে ইলম শিখবে, দ্বীন শিখবে। কিন্তু এখন অনেক ভাই মনে করে, চিল্লা দিয়েই পুরো দ্বীন ও ঈমান শিখে ফেলেছে। ইলিয়াস রাহ. এটা বলেননি যে, চিল্লা দিয়েই সব শিখবে; বরং চিল্লা দিয়ে কিছু শিখবে এবং জযবা তৈরি হবে। চিল্লা থেকে ফিরে বাকিগুলো আলেমদের কাছে গিয়ে শিখতে হবে। এর নাম হল ইলম ও যিকিরের মেহনত। এভাবে যদি আমরা চিল্লার কদর করি, তাহলে ইনশাআল্লাহ ফায়দা হবে।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে কবুল করুন, তাওফীক দান করুন-আমীন।

وآخرُ دعوانا أنِ الحمدُ لله ربِّ العالمين

অনলাইন নিউজ পোর্টাল

মন্তব্য করুন: