শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, চৈত্র ১৫ ১৪৩০, ১৯ রমজান ১৪৪৫

স্পেশাল

গরু-মহিষের সৌখিন খামার গড়ে সফল রেকাত আলী

 প্রকাশিত: ১৫:২৪, ৫ জুলাই ২০২২

গরু-মহিষের সৌখিন খামার গড়ে সফল রেকাত আলী

খামার তো নয় যেন এক সংগ্রহশালা! গরু আর মহিষের সৌখিন খামার গড়ে সফল হয়েছেন রেকাত আলী। প্রতিদিন অসংখ্য দর্শনার্থী খামারে থাকা দুই শতাধিক গরু-মহিষ দেখতে ভিড় করছেন। নাটোর সদর উপজেলার ডালসড়ক এলাকাতে ড্রিমল্যান্ড ফ্যাটেনিং এন্ড ডেইরি নামে বৈচিত্রময় এ খামারের অবস্থান। 

পেশায় চাল ব্যবসায়ী রেকাত আলীর বরাবরই ঝোঁক ছিল বাড়িতে গরু পালন করার। ছয় বছর আগে বাণিজ্যিকভাবে শুরু করেন হৃষ্টপুষ্ট কার্যক্রম। নিজস্ব রাইস মিলের চারপাশ জুড়ে গড়ে তুলেছেন গরুর আবাসন, অদূরেই ঘাসের খামার। প্রতিবছর একটু একটু করে খামারের পরিধি বাড়ছে।  

খামারে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে বিভিন্ন জাতের বিদেশী গরু। এরমধ্যে রয়েছে আমেরিকার বাহামা ও জিবিআর, অস্ট্রেলিয়ার ফ্রিজিয়ান ও হলিষ্টিন ফ্রিজিয়ান, নেপালের নেপালী গীর, পাকিস্তানের শাহীওয়াল, ভারতের রাজস্থান, গুজরাট, উলুবাড়িয়া জাতের গরু। লাল, সাদা, কালো রঙের এসব এক একটি গরু লম্বায় ৯ ফুট আর উচ্চতায় ৬ ফুটের বেশী। ওজনে কোন কোনটি এক টন ছাড়িয়ে গেছে। এক্ষেত্রে আমেরিকার বাহামা অগ্রগামী। রাজস্থানের রাজকীয় সিং অসাধারণ।  একটির গায়ের রঙ তো খানিকটা হরিণের মত। অতিকায় এসব গরুর পাশাপাশি আছে পাহাড়ের গোয়াল আর ক্ষুদ্রকায় সুস্বাদু মাংসে অনন্য ভুটানের ভুট্টি। সব গরুই শান্ত ও নিরীহ প্রকৃতির। কাছে গেলে আদর খেতে গলা বাড়িয়ে দিচ্ছে গরুগুলো। খামার মালিকের সাথে গরুগুলোর সখ্যতা চোখে পড়ার মত। অপরিসীম মমত্ববোধ দিয়ে পালন করেছেন তিনি গরুগুলোকে।

এ খামারে শুধু গরু নয়, আছে বিহারী ও আফ্রিকান জাতের বিশাল মহিষ। আছে জাফরাবাদী, নিলিরাভী, মুররা জাতের মহিষ। আকৃতিতে কেউ কারো চেয়ে কম নয়। আকর্ষণীয় এসব মহিষ ওজনে পনের মণ ছাড়িয়েছে। ব্যতিক্রমী সাদা রঙের এলবিনো মহিষ নিমিষেই নজর কাড়ে। নিরীহ এ মহিষগুলো দর্শনার্থী দেখলেই অপার বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে।   

বিপুল সংখ্যক দর্শনার্থীকে এসব গরু আর মহিষ দেখার কৌতুহল নিয়ে খামারটি পরিদর্শন করতে দেখা যাচ্ছে। কলেজ শিক্ষক মাসুমা সুলতানা বললেন, গরুর খামার যে দর্শনীয় হতে পারে তা এ খামারে এসে বুঝলাম। পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থী সিদরাতুল মুনতাহা ঘাস খেতে দিচ্ছিল গরুকে। ফিরে যাওয়ার তাগাদা দিতে বাবা-মাকে বললো, আরেকটু থাকি। গরুগুলোর সাথে অল্প সময়ের দেখাতেই মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে গেছে যেন !

শুধু কোরবানীর ঈদকে কেন্দ্র করেই নয়, সারা বছর ধরে এ খামারে কিছু না কিছু গরু থাকেই। গরুর পরিচর্যার জন্যে সার্বক্ষণিক নিয়োজিত আছেন ১২ জন কর্মচারী। তাদের দলনেতা বুলবুল আহমেদ জানান, গরুকে খাওয়ানো, গোসল করানো, অসুস্থতার দিকে নজর রাখাসহ সব কাজই আমরা করি। রাতে দুইজন দায়িত্ব পালন করেন। কর্মচারীদের মধ্যে কয়েকজন আবাসিক হওয়ায় তাদের পরিবারবর্গও আমাদের কাজে সহযোগিতা করে। অত্যন্ত পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন এ খামারের ব্যাপারে জানা গেল, গোবর হওয়ার সাথে সাথেই সরিয়ে নেওয়া হয়। আর তাই গরুগুলোর ত্বক ঝকঝকে, নিখুঁত।

খামারের অদূরেই নিজস্ব জমিতে চাষ করা হচ্ছে বিভিন্ন জাতের প্রয়োজনীয় ঘাস। নেপিয়ার, গোমা জাতের ঘাসছাড়াও আছে থাইল্যান্ডের পানচুন ঘাস। ২০ বিঘার এ খামারে এবছর নতুন সংযোজন করা হয়েছে লাল-সবুজে মাখানো পানচুনের হাইব্রীড জাত। খামারের গরুগুলোর চাহিদা মিটিয়ে অন্য গরু প্রতিপালনকারীরা বিনা অর্থে এ খামারের ঘাস, বীজ পেয়ে থাকেন বলে জানান স্থানীয়রা। সমাজ সেবাসহ মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত রেকাত আলী এলাকায় দাতা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। 

রেকাত আলী বলেন, গরুর খামার আমার পেশা নয়, অনেকটা নেশার মত। হাজারো ব্যস্ততার ভিড়ে প্রতিদিন ওদের সাথে দেখা না হলে মনে স্বস্তি আসেনা। গরুগুলোর সাথে যেন আমার আতœার সম্পর্ক। রাইস মিলের সাথে গরুর খামার অত্যন্ত লাভজনক বলে জানান তিনি।

কোরবানীর হাটে তোলার আগেই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ক্রেতারা গরু কিনতে খামারে আসছেন। সাদেক এগ্রো, বেঙ্গল ফার্ম ক্রেতাদের মধ্যে অন্যতম। রেকাত আলী বলেন, করোনা সংক্রমণের পরে ব্যবসায়ে আমরা অত্যন্ত আশাবাদী ছিলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয়, পশুর খাবার মূল্য বৃদ্ধি পেলেও আনুপাতিক হারে পশুর দাম বৃদ্ধি পায়নি। আবার, সিলেটের বন্যাও বিপণন ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে রেকাত আলী বলেন, পরিসর আরো বাড়াবো। একটা বায়োগ্যাস প্লান্টও গড়ে তুলতে চাই। তবে সবকিছু নির্ভর করছে, বাজারজাতকরণ পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে।

খামার তত্ত্বাবধানকারী খামারের অন্যতম পরিচালক রেকাত আলী বলেন, গুণগতমানের ব্যাপারে আমাদের কোন আপোষ নেই। খামারে কোনরকম স্টেরয়েড ব্যবহার করা হয়না, সম্পূর্ণ অর্গাণিক। ঘাস, গমের ভুষি আর খৈল ছাড়াও গম, ভুট্টা, খেসারী, ধান, ডাবলী ও ছোলা সহযোগে মিশ্র খাবার আমাদের খামারের বিশেষ খাদ্য-যা পশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।

জেলা পশু সম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ গোলাম মোস্তফা বলেন, রেকাত আলীর সৌখিন ও সমৃদ্ধ খামার নিয়ে আমরা গর্বিত। তাকে সহযোগিতা ও সমর্থন দেয়ার ধারাবাহিক প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে। 

নাটোরের জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন, বৈচিত্র্যময় ও সমৃদ্ধ ড্রিমল্যান্ড ফ্যাটেনিং এন্ড ডেইরি ফার্ম সুন্দর পরিবেশে মেধা ও পরিশ্রমে গড়ে তোলা হয়েছে। এ খামার দেশের সম্পদ বৃদ্ধির কাজে নিয়োজিত থেকে দেশজ উৎপাদনে ভূমিকা রাখছে। এ খামারের উন্নয়নে জেলা প্রশাসন পাশে থাকবে।

মন্তব্য করুন: