বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, চৈত্র ১৪ ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫

ইসলাম

কুরআন মাজীদের নাম-পরিচয় ‘আযযিকর’ নামের তাৎপর্য

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মাজীদ

 প্রকাশিত: ১৮:২৩, ১৯ জানুয়ারি ২০২২

কুরআন মাজীদের নাম-পরিচয় ‘আযযিকর’ নামের তাৎপর্য

ذِكْرٌ (যিকর) শব্দের মূল অর্থ স্মরণ রাখা এবং স্মরণ করা। যদিও অন্তরে স্মরণ করাই এর প্রাথমিক অর্থ কিন্তু মুখের ভাষায় যেহেতু মনের ভাব প্রকাশ পায় তাই ব্যবহারিক ক্ষেত্রে মুখে উচ্চারণ করা ও আলোচনা করাকেও ‘যিকর’ বলা হয়। এমনিভাবে ‘যিকর’ শব্দটি ‘তাযকীর’ অর্থেও ব্যবহৃত হয় অর্থাৎ স্মরণ করাকে যেমন ‘যিকর’ বলা হয় তেমনি স্মরণ করানোকেও যিকর বলা হয়। তাছাড়া ‘যিকর’ তথা স্মরণ করা ও স্মরণ করানোর বিভিন্ন ধরণ ও প্রকার রয়েছে।

 

তাই অন্তরে আল্লাহ তাআলাকে স্মরণ করাকে যেমন যিকর বলা হয় তেমনি মুখে আল্লাহ তাআলার নাম জপা, তাসবীহ ও তাহলীল পড়া, কুরআন মাজীদ তিলাওয়াত করা এবং তাঁর কাছে দুআ ও প্রার্থনা করাকেও যিকর বলা হয়। এমনকি কর্মে ও আচরণে আল্লাহ তাআলার হেদায়েত ও বিধানাবলি অনুসরণ করাকেও ব্যাপকার্থে যিকর বলা হয়। কেননা মনে ও মুখে স্মরণের দাবি কর্মে ও আচরণে স্মরণ করার মাধ্যমেই পূর্ণতা লাভ করে। সূরা বাকারার ১৫২ নং আয়াতে যে ইরশাদ হয়েছে-  فَاذْكُرُوْنِیْۤ اَذْكُرْكُمْ   ‘আমাকে স্মরণ করো, আমি তোমাদেরকে স্মরণ করব’- এর তাফসীরে বর্ণিত আছে যে, তোমরা আমার আদেশ-নিষেধ অনুসরণের মাধ্যমে আমাকে স্মরণ কর, তাহলে আমি তোমাদেরকে রহমত ও মাগফিরাতের মাধ্যমে স্মরণ করব। (দ্রষ্টব্য : তাফসীরে তবারী ২/৬৯৫; তাফসীরে ইবনে কাসীর ১/২৮৩)

আর এজন্যই কর্মগত ইবাদত-বন্দেগীকেও কুরআনে কারীমে ‘যিকর’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। যেমন, ইরশাদ হয়েছে-

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْۤا اِذَا نُوْدِیَ لِلصَّلٰوةِ مِنْ یَّوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا اِلٰی ذِكْرِ اللهِ وَ ذَرُوا الْبَیْعَ ...

হে মুমিনগণ! জুমার দিন যখন নামাযের জন্য ডাকা হয় তখন আল্লাহর যিকরের দিকে ধাবিত হও এবং বেচা-কেনা ছেড়ে দাও।... -সূরা জুমুআ (৬২) : ৯

উপরোক্ত আয়াতে যিকর দ্বারা খুতবা ও নামায বোঝানো হয়েছে।

এমনিভাবে যিকর শব্দের একটি প্রসিদ্ধ ব্যবহারিক অর্থ ওয়াজ ও নসীহত, কেননা এতে স্মরণ করানোর ভাব ও মর্ম পূর্ণ মাত্রায় বিদ্যমান।

দ্রষ্টব্য : আলমুফরাদাত ফী গরীবিল কুরআন ৩২৮; মাকাইসুল লুগাহ, ইবনু ফারিস ৩৬৮; লিসানুল আরব ৩/৩১০, ৪/৩১০; আসাসুল বালাগাহ, যমখশারী ২০৬; এবং অন্যান্য আরবী অভিধান।

কুরআন মাজীদের নাম হিসেবে আযযিকর’ শব্দের প্রয়োগ

কুরআনে কারীমের বহুসংখ্যক আয়াতে কুরআনকে الذكر (আযযিকর) নামে অভিহিত করা হয়েছে। এমনিভাবে একই শব্দমূল থেকে নির্গত الذكرى (আযযিকরা) এবং التذكرة (আততাযকিরাহ) উপাধিও কুরআনের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। কুরআনে এ ধরনের স্থান পঞ্চাশেরও অধিক। মাক্কী জীবনের একদম শুরুর দিকে যেসব সূরা নাযিল হয়েছে তাতেও এই নামগুলির উল্লেখ রয়েছে। এখানে উদাহরণস্বরূপ কিছু আয়াত উল্লেখ করছি :

ক) সূরা কলাম (মাক্কী)-এর ৫২ নং আয়াত-

وَ مَا هُوَ اِلَّا ذِكْرٌ لِّلْعٰلَمِیْنَ.

খ) সূরা তাকভীর (মাক্কী)-এর ২৭ নং আয়াত-

اِنْ هُوَ اِلَّا ذِكْرٌ لِّلْعٰلَمِیْنَ.

গ) সূরা ছ¦দ (মাক্কী)-এর ৮৭-৮৮ নং আয়াত-

اِنْ هُوَ اِلَّا ذِكْرٌ لِّلْعٰلَمِیْنَ،  وَ لَتَعْلَمُنَّ نَبَاَهٗ بَعْدَ حِیْنٍ.

ঘ) সূরা ইউসুফ (মাক্কী)-এর ১০৪ নং আয়াত-

وَ مَا تَسْـَٔلُهُمْ عَلَیْهِ مِنْ اَجْرٍ،  اِنْ هُوَ اِلَّا ذِكْرٌ لِّلْعٰلَمِیْنَ.

ঙ) সূরা হিজর (মাক্কী)-এর ৯ নং আয়াত-

اِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَ اِنَّا لَهٗ لَحٰفِظُوْنَ.

চ) সূরা তালাক-এর ১০ নং আয়াত-

قَدْ اَنْزَلَ اللهُ اِلَیْكُمْ ذِكْرًا.

আল্লাহ তাআলা তোমাদের প্রতি অবতীর্ণ করেছেন আদ্যোপান্ত এক উপদেশবাণী।

কুরআনের জন্য আততাযকিরাহ’ শব্দের ব্যবহার

التذكرة (আততাযকিরাহ) অর্থ স্মারক; স্মরণ করিয়ে দেয় এমন যে কোনো উপকরণ এবং উপদেশমূলক যেকোনো কথা, কর্ম, ঘটনা ও বস্তু। কুরআনের জন্য এই শব্দটি বহু স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন-

১। সূরা মুদ্দাসসিরের ৫৪-৫৫ নং আয়াত-

كَلَّاۤ اِنَّهٗ تَذْكِرَةٌ،  فَمَنْ شَآءَ ذَكَرَهٗ،  وَ مَا یَذْكُرُوْنَ اِلَّاۤ اَنْ یَّشَآءَ اللهُ،  هُوَ اَهْلُ التَّقْوٰی وَ اَهْلُ الْمَغْفِرَةِ.

কখনোও নয়। এই কুরআনই (সকলের জন্য যথেষ্ট) উপদেশ। সুতরাং যার ইচ্ছা সে এর থেকে উপদেশ গ্রহণ করুক। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতিরেকে তারা উপদেশ গ্রহণ করতে পারবে না। তিনিই এর উপযুক্ত যে, তাঁকে ভয় করা হবে এবং তিনিই এর উপযুক্ত যে, মানুষকে ক্ষমা করবেন।

২। সূরা আবাসার ১১-১২ নং আয়াত-

كَلَّاۤ اِنَّهَا تَذْكِرَةٌ،  فَمَنْ شَآءَ ذَكَرَهٗ.

কিছুতেই এরূপ উচিত নয়। এ কুরআন তো এক উপদেশবাণী। যার ইচ্ছা সে একে স্মরণ রাখবে।

কুরআনের জন্য যিকরা’ শব্দের ব্যবহার

 ذكرى (যিকরা) শব্দটি ‘যিকর’-এর সমার্থক। তবে  ‘যিকরা’ শব্দটি অধিক জোরালো। এটি অধিক পরিমাণে স্মরণ করা বোঝায়। এছাড়াও শব্দটি কখনো কখনো تذكرة  (তাযকিরাহ) তথা স্মারক অর্থেও ব্যবহৃত হয়।

ذِكْرٰی শব্দটি সরাসরি কুরআনে কারীমের জন্য কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন, সূরা আনআমের ৯০ নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-

اِنْ هُوَ اِلَّا ذِكْرٰی لِلْعٰلَمِیْنَ.

এটা তো বিশ্বজগতের জন্য এক উপদেশমাত্র।

সূরা আরাফের ২ নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-

كِتٰبٌ اُنْزِلَ اِلَیْكَ فَلَا یَكُنْ فِیْ صَدْرِكَ حَرَجٌ مِّنْهُ لِتُنْذِرَ بِهٖ وَ ذِكْرٰی لِلْمُؤْمِنِیْنَ.

এটি একখানি কিতাব, যা তোমার প্রতি নাযিল করা হয়েছে। যাতে তুমি এর দ্বারা মানুষকে সতর্ক কর। সুতরাং এর কারণে তোমার অন্তরে যেন কোনো দুশ্চিন্তা না জাগে এবং এটা মুমিনদের জন্য এক উপদেশবাণী।

সূরা আনকাবুতের ৫১ নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-

اَوَ لَمْ یَكْفِهِمْ اَنَّاۤ اَنْزَلْنَا عَلَیْكَ الْكِتٰبَ یُتْلٰی عَلَیْهِمْ،  اِنَّ فِیْ ذٰلِكَ لَرَحْمَةً وَّ ذِكْرٰی لِقَوْمٍ یُّؤْمِنُوْنَ.

তবে কি তাদের জন্য এটা যথেষ্ট নয় যে, আমি তোমার প্রতি কিতাব নাযিল করেছি, যা তাদেরকে পড়ে শোনানো হচ্ছে? নিশ্চয়ই যে সমস্ত লোক বিশ্বাস করে তাদের জন্য এতে রয়েছে রহমত ও উপদেশ।

আযযিকর’ নামের তাৎপর্য ও ব্যঞ্জণা

‘আযযিকর’ নামটি অর্থ-প্রাচুর্যে সমৃদ্ধ ও ব্যঞ্জনাময় একটি শব্দ। এতে যেসব তাৎপর্য ও ব্যঞ্জনা নিহিত রয়েছে, তার কিছু এখানে উল্লেখ করছি :

এক. ‘যিকর’ অর্থ  স্মরণ। এই অর্থে কুরআনে কারীম হল আল্লাহর যিকির ও স্মরণ। কেননা কুরআনে কারীম হল আল্লাহর কালাম ও বাণী। তাই কুরআনে কারীম পাঠ করা মহামহিম আল্লাহ পাকের শ্রেষ্ঠ যিকির, যার প্রতিটি হরফ তিলাওয়াতে দশটি করে সওয়াব লাভের কথা হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। এর প্রতিটি শব্দ  পাঠক ও শ্রোতার অন্তরে আল্লাহর স্মরণকে জাগ্রত করে। বান্দা যতক্ষণ কুরআনের সঙ্গে থাকে ততক্ষণ সে আল্লাহর একান্ত সান্নিধ্যে থাকে। এজন্যই কুরআন পাঠে এত লযযত ও স্বাদ অনুভূত হয়। মাটির তৈরি নগণ্য মানুষের কী সৌভাগ্য যে, খালিক ও মালিক মহান আল্লাহ আপন কালামের মাধ্যমে তাকে সম্বোধন করেছেন এবং তাকে বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন স্বীয় উলুহিয়্যাত ও রবুবিয়্যাতের কথা। আল্লাহর যিকির ও স্মরণ জাগ্রত করার এই অসাধারণ অলৌকিক গুণ সম্পর্কে কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-

اَللهُ نَزَّلَ اَحْسَنَ الْحَدِیْثِ كِتٰبًا مُّتَشَابِهًا مَّثَانِیَ تَقْشَعِرُّ مِنْهُ جُلُوْدُ الَّذِیْنَ یَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ، ثُمَّ تَلِیْنُ جُلُوْدُهُمْ وَ قُلُوْبُهُمْ اِلٰی ذِكْرِ اللهِ ...

আল্লাহ নাযিল করেছেন উত্তম বাণী- এমন এক কিতাব, যার বিষয়বস্তুসমূহ পরস্পর সুসমঞ্জস, (যার বক্তব্যসমূহ) পুনরাবৃত্তিকৃত। যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে এর দ্বারা তাদের শরীর রোমাঞ্চিত হয়। তারপর তাদের দেহ-মন বিগলিত হয়ে আল্লাহর স্মরণে ঝুঁকে পড়ে।... -সূরা যুমার (৩৯) : ২৩

দুই. ‘যিকর’ শব্দের আরেক অর্থ ‘তাযকীর’ তথা স্মরণ করানো এবং যা কোনো কিছুকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এক শব্দে বললে ‘স্মারক’ বলা যায়। এই অর্থে কুরআন মাজীদ হল এমন এক স্মারক গ্রন্থ, যা মানব জাতিকে এমনসব সরল, সঠিক ও সত্য বিষয় বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়, যা পূর্ব থেকে মানুষের ফিতরাত ও প্রকৃতির মাঝে নিহিত রয়েছে। কিন্তু মানুষ স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ফিতরাতের কথা ভুলে থাকে। তাই কুরআন জ্ঞানভিত্তিক ও বাস্তবসম্মত শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের ঈমানী ফিতরাতকে জাগিয়ে তোলে, তার সুপ্ত যোগ্যতার উৎকর্ষ সাধন করে। দু®কৃতি ও ভ্রষ্টতার বিরুদ্ধে যে জন্মগত ঘৃণা রয়েছে তাকেও উদ্দীপ্ত করে।

ফিতরাত হল সেই মজ্জাগত যোগ্যতা, যা আল্লাহ তাআলা প্রতিটি মানুষের ভেতর জন্মগতভাবেই নিহিত রেখেছেন। মানুষ চাইলে এই যোগ্যতার মাধ্যমে নিজ সৃষ্টিকর্তা ও মালিককে চিনতে পারবে, তাওহীদের মর্ম বুঝতে ও মানতে পারবে এবং আম্বিয়ায়ে কেরাম যে দ্বীন ও হেদায়েত নিয়ে আগমন করেছেন তা গ্রহণ করতে এবং অনুসরণ করতে সক্ষম হবে। মানুষের স্বভাবগত ও মজ্জাগত এই যোগ্যতার পরিপূর্ণ বিলুপ্তি অসম্ভব। পরিবেশ ও পরিস্থিতির প্রভাবে মানুষ ভুল পথে যেতে পারে, কিন্তু তাতে তার জন্মগত সে ক্ষমতা ও যোগ্যতার বিলুপ্তি ঘটে না। এজন্যই মানুষ যদি তার জিদ পরিত্যাগ করে এবং সত্যসন্ধানী দৃষ্টিভঙ্গিতে চিন্তা করে তাহলে এ যোগ্যতার সুফল সে লাভ করবে এবং সত্য তার সামনে অবশ্যই উদ্ভাসিত হবে। আল্লাহ তাআলা কুরআনে ইরশাদ করেন-

فَاَقِمْ وَجْهَكَ لِلدِّیْنِ حَنِیْفًا، فِطْرَتَ اللهِ الَّتِیْ فَطَرَ النَّاسَ عَلَیْهَا، لَا تَبْدِیْلَ لِخَلْقِ اللهِ، ذٰلِكَ الدِّیْنُ الْقَیِّمُ،  وَ لٰكِنَّ اَكْثَرَ النَّاسِ لَا یَعْلَمُوْنَ.

সুতরাং তুমি নিজেকে একনিষ্ঠভাবে এই দ্বীনের অভিমুখী রাখো। সেই ফিতরাত অনুযায়ী চল, যে ফিতরাতের উপর তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টিতে কোনো পরিবর্তন সাধন করা সম্ভব নয়। এটাই সম্পূর্ণ সরল পথ। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না। -সূরা রূম (৩০) : ৩০

সর্বোপরি কুরআনে কারীম আদম সন্তানকে স্মরণ করিয়ে দেয় আল্লাহ তাআলার সাথে আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি ও স্বীকারোক্তির কথা, যা আল্লাহ তাআলা মানুষকে দুনিয়ায় পাঠানোর আগেই তাদের থেকে নিয়েছিলেন। আল্লাহ তাআলা কুরআনে ইরশাদ করেন-

وَ اِذْ اَخَذَ رَبُّكَ مِنْۢ بَنِیْۤ اٰدَمَ مِنْ ظُهُوْرِهِمْ ذُرِّیَّتَهُمْ وَ اَشْهَدَهُمْ عَلٰۤی اَنْفُسِهِمْ اَلَسْتُ بِرَبِّكُمْ، قَالُوْا بَلٰی، شَهِدْنَا، اَنْ تَقُوْلُوْا یَوْمَ الْقِیٰمَةِ اِنَّا كُنَّا عَنْ هٰذَا غٰفِلِیْنَ.

এবং (হে রাসূল! মানুষকে সেই সময়ের কথা স্মরণ করিয়ে দাও) যখন তোমার প্রতিপালক আদম সন্তানদের পৃষ্ঠদেশ থেকে তাদের সন্তানদেরকে বের করেছিলেন এবং তাদেরকে তাদের নিজেদের সম্পর্কে সাক্ষী বানিয়েছিলেন (আর জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে,) আমি কি তোমাদের রব নই? সকলে উত্তর দিয়েছিল, কেন নয়? আমরা সকলে এ বিষয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছি। (আর এ স্বীকারোক্তি আমি এজন্য নিয়েছিলাম) যাতে কিয়ামতের দিন তোমরা বলতে না পার যে, আমরা তো এ বিষয়ে অনবহিত ছিলাম। -সূরা আরাফ (৭) : ১৭২

তিন. স্মারক অর্থে ‘আযযিকর’ নামটি কুরআন অবতারণের মাকসাদ ও উদ্দেশ্য নির্দেশ করে। কেননা কুরআনে কারীম হল গাফলত ও বিস্মৃতি থেকে জাগ্রতকারী আসমানী স্মারকগ্রন্থ, যার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হল ‘তাযকীর’ বা স্মরণ করানো। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার তাওহীদ ও একত্বের কথা, তাঁর কুদরত ও ক্ষমতার কথা, তাঁর মহিমা ও বড়ত্ব এবং তাঁর দয়া অনুগ্রহের কথা স্মরণ করানো। সৃষ্টি জগতের কুদরতি নিদর্শনাবলি স্মরণ করানো। বিগত জাতীসমূহের  শিক্ষণীয় ঘটনাসমূহ স্মরণ করানো। পুনরুত্থান ও পরকালের কথা স্মরণ করানো। জান্নাত ও জাহান্নামের কথা স্মরণ করানো। এসব বিষয় স্মরণ করিয়ে দিয়ে ঈমান ও আমলে সালেহ-এর প্রতি উৎসাহ জাগানোই কুরআন মাজীদের অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।

আল্লাহ তাআলা কুরআনে ইরশাদ করেছেন-

وَ كَذٰلِكَ اَنْزَلْنٰهُ قُرْاٰنًا عَرَبِیًّا وَّ صَرَّفْنَا فِیْهِ مِنَ الْوَعِیْدِ لَعَلَّهُمْ یَتَّقُوْنَ اَوْ یُحْدِثُ لَهُمْ ذِكْرًا.

এভাবেই আমি এ ওহীকে আরবী পাঠরূপে নাযিল করেছি এবং তাতে সতর্কবাণী বর্ণনা করেছি বিভিন্নভাবে। যাতে তারা তাকওয়া অবলম্বন করে কিংবা এ কুরআন তাদের ভেতর কিছুটা চিন্তা-চেতনা উৎপাদন করে। -সূরা ত্বহা (২০) : ১১৩

চার. যিকর, যিকরা এবং তাযকিরা- এই শব্দগুলোর সর্বাধিক প্রসিদ্ধ ব্যবহারিক অর্থ হচ্ছে, ওয়াজ-নসীহত। কেননা ওয়ায-নসীহত মানুষকে জাগানোর এবং করণীয় ও বর্জনীয় বিষয় স্মরণ করানোর একটি মর্মস্পর্শী উপায়।

এছাড়া কুরআনে কারীমের বিশেষণরূপে সরাসরি ‘মাওয়েজা’ শব্দও কুরআনে একাধিক স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে। কিছু আয়াত এখানে উল্লেখ করছি-

هٰذَا بَیَانٌ لِّلنَّاسِ وَ هُدًی وَّ مَوْعِظَةٌ لِّلْمُتَّقِیْنَ.

এটা মানুষের জন্য সুস্পষ্ট ঘোষণা। আর মুত্তাকীদের জন্য হেদায়েত ও উপদেশ। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১৩৮

یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ قَدْ جَآءَتْكُمْ مَّوْعِظَةٌ مِّنْ رَّبِّكُمْ وَ شِفَآءٌ لِّمَا فِی الصُّدُوْرِ،  وَ هُدًی وَّ رَحْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِیْنَ.

হে মানুষ! তোমাদের কাছে এমন এক জিনিস এসেছে, যা তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে এক উপদেশ, অন্তরের রোগ-ব্যধির উপশম এবং মুমিনদের পক্ষে হেদায়েত ও রহমত। -সূরা ইউনুস (১০) : ৫৭

উক্ত আয়াতে কুরআন কারীমের জন্য মাওয়েজা, শিফা, হুদা ও রহমত- এই চারটি বিশেষণ একইসাথে ব্যবহৃত হয়েছে।

মাওয়েজা এবং ওয়াজ সমার্থক শব্দ। উভয় শব্দের মূল ধাতু এক। আরবীতে ‘ওয়াজ’ শব্দের মর্ম কী- তা আরবী ভাষাবিদ ও মুফাসসিরগণ বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। যেমন আল্লামা রাগেব আসফাহানী রাহ. লিখেছেন-

الوعظ : زجر مقترن بتخويف، قال الخليل : هو التذكير بالخير فيما يرق له القلب. (المفردات في غريب القرآن ৬৮৬)

‘ওয়ায হচ্ছে কোনো বিষয়ে ভীতি প্রদর্শন সহকারে সতর্কীকরণ। ইমাম খলীল বলেন, ওয়ায হচ্ছে, উত্তম ও কল্যাণকর কর্মের কথা এমনভাবে স্মরণ করিয়ে দেয়া, যাতে সেই কর্মের জন্য হৃদয় বিগলিত হয়।’

আরবী ভাষাবিদ ইবনে মানযূর রাহ. লিখেছেন-

الوعظ والعظة والموعظة : النصح والتذكير بالعواقب، قال ابن سيدة : هو تذكير للإنسان بما يلين قلبه من ثواب وعقاب. (لسان العرب ৪৬৬/৭)

‘ওয়ায ও মাওয়েযা হচ্ছে, উপদেশদান এবং কর্মের পরিণতি স্মরণ করিয়ে দেয়া।

ভাষাবিদ ইবনু সীদাহ বলেন, ওয়ায হচ্ছে, মানুষকে পুরস্কার ও শাস্তির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া, যাতে তার হৃদয় নরম ও বিগলিত হয়।’

মোটকথা ওয়াজ হচ্ছে, কোনো বিষয়ে নিঃস্বার্থ ও নিষ্ঠাপূর্ণ, নিখাঁদ ও নির্ভুল এবং হৃদয়গ্রাহী ও আবেদনপূর্ণ উপদেশ, যা অন্তরকে আলোড়িত করে, সত্য ও সঠিক বিষয় গ্রহণ করতে উৎসাহিত করে, মিথ্যা ও মন্দের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করে।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ওয়ায-নসীহত তার পূর্ণাঙ্গ অর্থে এবং সর্বোচ্চ স্তরে কুরআনে বিদ্যমান।

প্রকৃত অর্থে কুরআনে কারীম আগাগোড়া মাওয়ায়েয ও উপদেশমালায় পরিপূর্ণ। এর বর্ণনাশৈলী, যুক্তিপ্রমাণ, উপস্থাপন পদ্ধতি, বিন্যাসরীতি, বিষয়বস্তু এবং ভাষা সবই অত্যন্ত বলিষ্ঠ, দৃপ্ত ও আবেদনপূর্ণ। তা হৃদয়কে গভীরভাবে স্পর্শ করে। মন-মগজের গাফলত দূরীভূত করে। আবেগের সমুদ্রে তরঙ্গ সৃষ্টি করে। চিন্তার জগৎ বদলে দেয়। আল্লাহভীতি ও আখেরাতের চিন্তা জাগ্রত করে এবং আল্লাহ তাআলার বন্দেগী ও আনুগত্যের ব্যাপারে অনুপ্রেরণা ও দৃঢ় সংকল্প সৃষ্টি করে। এ সম্পর্কে বিশদ আলোচনা তো এক সুদীর্ঘ বিষয়। আমরা এখানে এ বিষয় সম্পর্কে দু-চার কথা সংক্ষেপে আরয করব।

আমরা কুরআনে কারীম পাঠ করলে দেখতে পাই যে, ইতিহাস লেখার পদ্ধতিতে কোথাও ইতিহাস লেখা হয়নি। অতি প্রাকৃতিক বিষয়াবলিকে দর্শনের ভাষায় লেখা হয়নি। মানুষ ও বিশ্বজাহানের বস্তু ও পদার্থের আলোচনা করা হয়েছে, কিন্তু জীববিদ্যা ও পদার্থ বিজ্ঞানের পদ্ধতিতে করা হয়নি। সভ্যতা, সংস্কৃতি, রাজ্যশাসন, অর্থনীতি ও সমাজজীবনের বিভিন্ন বিষয়ের উপর আলোচনা করা হয়েছে, কিন্তু তাতে সমাজবিজ্ঞানের পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়নি। আইনগত বিধান ও আইনের মূলনীতি বর্ণনা করা হয়েছে, কিন্তু আইন শাস্ত্রের পদ্ধতিতে নয়। নৈতিকতার যে শিক্ষা বিবৃত হয়েছে তার বর্ণনাভঙ্গি নীতিশাস্ত্র সংক্রান্ত বইপত্রের বর্ণনাভঙ্গি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।

মূলত কুরআন কারীমে দাওয়াতী ও হেদায়েতী মাকসাদের জন্য তাযকীর ও মাওয়েজা তথা ওয়ায-নসীহতের এক বিস্ময়কর শৈলী অবলম্বন করা হয়েছে। এখানে আমরা এর কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরছি। যেমন ধরুন, সুদ হারাম। এই বিধান বর্ণনা প্রসঙ্গে কুরআনে বলা হয়েছে-

اَلَّذِیْنَ یَاْكُلُوْنَ الرِّبٰوا لَا یَقُوْمُوْنَ اِلَّا كَمَا یَقُوْمُ الَّذِیْ یَتَخَبَّطُهُ الشَّیْطٰنُ مِنَ الْمَسِّ  ذٰلِكَ بِاَنَّهُمْ قَالُوْۤا اِنَّمَا الْبَیْعُ مِثْلُ الرِّبٰوا ۘ وَ اَحَلَّ اللهُ الْبَیْعَ وَ حَرَّمَ الرِّبٰوا فَمَنْ جَآءَهٗ مَوْعِظَةٌ مِّنْ رَّبِّهٖ فَانْتَهٰی فَلَهٗ مَا سَلَفَ  وَ اَمْرُهٗۤ اِلَی اللهِ  وَ مَنْ عَادَ فَاُولٰٓىِٕكَ اَصْحٰبُ النَّارِ  هُمْ فِیْهَا خٰلِدُوْنَ،  یَمْحَقُ اللهُ الرِّبٰوا وَ یُرْبِی الصَّدَقٰتِ  وَ اللهُ لَا یُحِبُّ كُلَّ كَفَّارٍ اَثِیْمٍ.

যারা সুদ খায়, (কিয়ামতের দিন) তারা সেই ব্যক্তির মত উঠবে, শয়তান যাকে স্পর্শ দ্বারা পাগল বানিয়ে দিয়েছে। এটা এজন্য হবে যে, তারা বলেছিল, ‘ব্যবসাও তো সুদেরই মত। অথচ আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন। সুতরাং যে ব্যক্তির নিকট তার প্রতিপালকের পক্ষ হতে উপদেশ-বাণী এসে গেছে, সে যদি (সুদী কারবার হতে) নিবৃত্ত  হয়,  তবে  অতীতে যা-কিছু  হয়েছে তা তারই। আর তার (অভ্যন্তরীণ অবস্থার) ব্যাপার আল্লাহর এখতিয়ারে। আর যে ব্যক্তি পুনরায় (সে কাজই) করল, তো এরূপ লোক জাহান্নামী হবে। তারা তাতেই সর্বদা থাকবে। -সূরা বাকারা (২) : ২৭৫

দেখুন, সুদ হারাম হওয়া সম্পর্কে কুরআনের কেমন দৃপ্ত ঘোষণা! কেমন ভয়ঙ্কর হুঁশিয়ার বাণী! প্রতিটি শব্দ যেন তার ভাব ও মর্ম শ্রোতার অন্তরের অন্তস্তলে পৌঁছে দিচ্ছে এবং সুদের প্রতি ঘৃণা জাগ্রত করছে।

এরপর দেখুন, দাম্পত্য জীবনের একটি একান্ত বিধান তালাক। এ সম্পর্কে কুরআনে একটি স্বতন্ত্র সূরা রয়েছে। এই সূরাটি পড়ে দেখুন। এতে তালাকের বিধান বর্ণিত হয়েছে, কিন্তু কী মর্মস্পর্শী ভাষায়! কতবার সেখানে আল্লাহ তাআলাকে ভয় করার এবং তাঁর নির্ধারিত সীমারেখা রক্ষা করার উপদেশ দেওয়া হয়েছে এবং কতবার সেখানে উচ্চারিত হয়েছে আল্লাহ তাআলার নাম ও তাঁর হুঁশিয়ারি!

আরেকটি উদাহরণ দেখুন, সূরা আররাহমান, যা الآيات الكونية তথা বিশ্বজগতের সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা কুদরতী নিদর্শনের বিবরণ সম্বলিত স্বতন্ত্র সূরা, কিন্তু দেখুন, এতে একেকটি খ- বক্তব্যের পর বারংবার-

فَبِاَیِّ اٰلَآءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبٰنِ.

(তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কোন্ কোন্্ নিআমত অস্বীকার করবে?) এ বাক্যটি উচ্চারিত হয়েছে মোট একত্রিশ বার।

এই পুনঃ পুনঃ উচ্চারণ একদিকে যেমন শৈল্পিক ও আলংকারিক সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে, তেমনি অন্যদিকে একটি ভাবগত আবহ তৈরি করেছে, যা শ্রোতাকে সমগ্র বক্তব্যের সাথে পূর্ণ একাত্ম হতে উদ্বুদ্ধ করে এবং আল্লাহর গুণ ও কুদরত, অনুগ্রহ ও নিআমতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

তদ্রূপ সূরা ক্বমার-এ

وَ لَقَدْ یَسَّرْنَا الْقُرْاٰنَ لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِنْ مُّدَّكِرٍ.

‘উপদেশ গ্রহণের জন্য কুরআনকে আমি সহজ করেছি। সুতরাং আছে কি কোনো উপদেশ গ্রহণকারী’-বাক্যটি চার বার চারজন নবীর কওমকে ধ্বংস করার সংক্ষিপ্ত কিন্তু মনোজ্ঞ বিবরণের পর উচ্চারিত হয়েছে। কারণ কুরআনে বর্ণিত জাতিবর্গের ঘটনার উদ্দেশ্যই হচ্ছে চিন্তার মাধ্যমে উপদেশ গ্রহণ। এখানে নির্ধারিত ব্যবধানে আয়াতটির পুনঃ পুনঃ উচ্চারণ আলংকারিক ও শৈল্পিক সৌন্দর্য যেমন সৃষ্টি করেছে, তেমনি একটি ভাবগত অবস্থা সৃষ্টি করেছে, যা শ্রোতাকে কুরআন-চিন্তায় উদ্বুদ্ধ করে এবং এই অনুভূতি জাগ্রত করে যে, বিগত জাতিগুলো তাদের উপর অবতীর্ণ কিতাব থেকে চিন্তা ও উপদেশ গ্রহণ না করার কারণেই ধ্বংস হয়েছে। সুতরাং উম্মতে মুহাম্মাদীর কর্তব্য হল, বিগত জাতির ভুলের পুনরাবৃত্তি না করা; বরং কুরআনকে চিন্তা ও উপদেশের মাধ্যমরূপে গ্রহণ করা।

এভাবে কুরআনে আলোচনা করা হয়, পৃথিবী ও আকাশের গঠনাকৃতির। মানুষ সৃষ্টির প্রক্রিয়া-পদ্ধতি এবং বিশ্বজগতের নিদর্শনসমূহ পর্যবেক্ষণের ও অতীতে বিভিন্ন জাতির ঐতিহাসিক ঘটনাবলির। এইসাথে অন্যান্য আরো বহু জিনিসের উল্লেখ করা হয়। কিন্তু মানুষকে পদার্থ বিদ্যা, জীববিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন বা অন্য কোনো বিদ্যা শিক্ষা দেওয়ার জন্য কুরআনে এগুলো আলোচনা করা হয়নি; বরং তাযকীর ও নসীহতের মাধ্যমে ঈমান ও আখলাকের তরবিয়াত, কলব ও হৃদয়কে পরিশুদ্ধ করা এবং আল্লাহর মর্জি মোতাবেক চলার প্রেরণা ও শিক্ষা দান করা এর উদ্দেশ্য। এ কারণেই এতে প্রতিটি বিষয়ের আলোচনা কেবলমাত্র ততটুকুই এবং সেই ভঙ্গিমায় করা হয়েছে, যতটুকু এবং যে ভঙ্গিমায় করা তার মূল লক্ষ্যের জন্য প্রয়োজন। প্রয়োজন মতো এসব বিষয়ের আলোচনা করার পর কুরআন সবসময় অপ্রয়োজনীয় বিস্তারিত আলোচনা বাদ দিয়ে নিজের উদ্দেশ্য ও কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয়ের দিকে ফিরে এসেছে।

আশা করি, আমরা বুঝতে পেরেছি যে, এই কুরআন তার সমগ্র পরিসরে কোথাও তার কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয় এবং মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থেকে এক চুল পরিমাণও সরে যায়নি। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তার বিভিন্ন ধরনের ঘটনা-বিষয়াবলি তার কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয়ের সাথে এমনভাবে সংযুক্ত আছে, যেমন একটি মোতির মালার বিভিন্ন রংয়ের ছোট-বড় মোতি একটি সুতোর বাঁধনে একসাথে, একত্রে একটি নিবিড় সম্পর্কে গাঁথা থাকে।

এরপর দেখুন, কুরআনে কারীমে একই বিষয়ের আলোচনা বিভিন্ন স্থানে বারবার এসেছে। একই বিষয়বস্তুকে বিভিন্ন আঙ্গিকে বিভিন্ন শব্দের মোড়কে পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে।

বিশেষত যেসব বিষয়বস্তু উপেদশ গ্রহণের মাধ্যম ও উপকরণ এবং যেসব বিষয় আল্লাহভীতি ও আখেরাতের চিন্তা জাগ্রত করে। যেমন, কাসাস তথা বিগত উম্মতের শিক্ষণীয় ঘটনাবলি, আল্লাহর নিআমতরাজির আলোচনা, আখেরাতের জবাবদিহিতা, জান্নাত-জাহান্নামের বৃত্তান্ত। এমনিভাবে তাওহীদ, আল্লাহর গুণাবলি, রিসালাত, কিতাবের উপর ঈমান, তাকওয়া, সবর, তাওয়াক্কুল এবং এ ধরনের ঈমানী ও আখলাকী অন্যান্য মৌলিক বিষয়ের আলোচনা কোথাও সংক্ষিপ্ত এবং কোথাও বিশদভাবে পুরো কুরআনে বারবার দেখা যায়। পক্ষান্তরে শরয়ী আহকাম ও বিধি-বিধান আলোচনার ক্ষেত্রে কুরআনের রীতি হল, খুঁটিনাটি বিষয়ের বিস্তারিত আলোচনার পরিবর্তে মৌলিক বিধি-বিধান ও নীতিমালা উপস্থাপন করা। যেমন, শরয়ী বিধানের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিধান ইবাদত-বন্দেগীর কথা এবং আমলে সালেহের কথা কুরআনে বারবার এসেছে। কিন্তু বিস্তারিত খুুঁটিনাটি বিষয় এবং প্রায়োগিক রূপ আলোচনা করা হয়নি; বরং মৌলিক নির্দেশনা ও নীতিমালা উল্লেখ করা হয়েছে।

কেননা কুরআনে প্রদত্ত শরীয়তের প্রায়োগিক রূপ পেশ করা এবং শাখাগত বিধি-বিধান ও খুঁটিনাটি বিষয় বর্ণনা করা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাজ ছিল, যাকে আল্লাহ তাআলা কুরআনের তিলাওয়াত শেখানোর, কুরআনের বিধান ও শিক্ষা ব্যাখ্যা করার দায়িত্ব দিয়েছেন। একইসাথে তাঁকে উসওয়ায়ে হাসানা সাব্যস্ত করেছেন এবং কুরআনী শিক্ষা ও স্বীয় উসওয়ায়ে হাসানার মাধ্যমে মানুষকে পরিশুদ্ধ করার দায়িত্ব দিয়েছেন।১

পাঁচ. কুরআনকে ذِكْرٌ للعالمين সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য উপদেশ বলা হয়েছে। সুতরাং কুরআনের ‘যিকর’ নামের অনিবার্য দাবি হচ্ছে, কুরআন মাজীদের বিধান ও শিক্ষা স্থান-কাল নির্বিশেষে গোটা মানবজাতির জন্য অবশ্য-গ্রহণীয় ও অপরিহার্যরূপে অনুসরণীয়।

ছয়. কুরআন মাজীদকে ‘আযযিকরুল হাকীম’ এবং ‘আলমাওইযাতুল হাসানাহ’ বলা হয়েছে। তার মানে, কুরআনে কারীমে যেসব উপদেশমূলক কথা, শিক্ষণীয় ঘটনাবলি এবং ওয়ায ও নসীহতের বিষয়বস্তু বর্ণিত হয়েছে, তার সবকিছুই ন্যায়সঙ্গত ও ভারসাম্যপূর্ণ এবং ষোল আনা নিখুঁত ও বাস্তবসম্মত। এতে কোনো রূপকথা ও কল্পকাহিনী নেই। কোনো বাহানা বা অপ্রয়োজনীয় কথা নেই। সুতরাং কুরআনে কারীম সাধারণ  কোনো উপদেশবাণী নয়; বরং (الذكر الحكيم) আযযিকরুল হাকীম এবং আলমাওইযাতুল হাসানাহ।

সূরা আলে ইমরানের ৫৮ নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-

ذٰلِكَ نَتْلُوْهُ عَلَیْكَ مِنَ الْاٰیٰتِ وَ الذِّكْرِ الْحَكِیْمِ.

(এসব আমি তোমাকে তিলাওয়াত করে শোনাচ্ছি- আয়াতসমূহ ও সারগর্ভ উপদেশবাণী।)

উক্ত আয়াতে আলহাকীম বিশেষণের অর্থ প্রজ্ঞাময় ও বস্তুনিষ্ঠ হওয়া উভয়টিই উদ্দেশ্য। [দ্রষ্টব্য : আলমুফরাদাত ফী গরীবিল কুরআন ২৪৮; তরজমাতু শায়খিল হিন্দ, (প্রাগুক্ত আয়াত)]

সূরা হা-মীম-সাজদার ৪১ নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-

اِنَّ الَّذِیْنَ كَفَرُوْا بِالذِّكْرِ لَمَّا جَآءَهُمْ وَ اِنَّهٗ لَكِتٰبٌ عَزِیْزٌ، لَّا یَاْتِیْهِ الْبَاطِلُ مِنْۢ بَیْنِ یَدَیْهِ وَ لَا مِنْ خَلْفِهٖ تَنْزِیْلٌ مِّنْ حَكِیْمٍ حَمِیْدٍ.

[যারা তাদের কাছে উপদেশপূর্ণ এ কিতাব আসার পর একে অস্বীকার করেছে (তারা নেহাৎ মন্দ কাজ করেছে) অথচ এটি অতি মর্যাদাপূর্ণ কিতাব। কোনো মিথ্যা এতে অনুপ্রবেশ করতে পারে না। না এর সম্মুখ দিক থেকে এবং না এর পেছন থেকে।]

সূরা ক্বমারের ৪-৫ নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-

وَ لَقَدْ جَآءَهُمْ مِّنَ الْاَنْۢبَآءِ مَا فِیْهِ مُزْدَجَرٌ،  حِكْمَةٌۢ بَالِغَةٌ فَمَا تُغْنِ النُّذُرُ.

[নিশ্চয়ই ওদের নিকট এমন সব সংবাদ এসে পৌঁছেছে, যার মধ্যে আছে সাবধানবাণী, পরিপূর্ণ প্রজ্ঞার কথা, তবু এই সতর্কবাণী ওদের উপকারে আসে না।)

সূরা হুদের ১ নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-

الٓرٰ كِتٰبٌ اُحْكِمَتْ اٰیٰتُهٗ ثُمَّ فُصِّلَتْ مِنْ لَّدُنْ حَكِیْمٍ خَبِیْرٍ.

(আলিফ-লাম-রা। এটি এমন এক কিতাব, যার আয়াতসমূহকে সুদৃঢ় করা হয়েছে। অতঃপর এমন এক সত্তার পক্ষ থেকে বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, যিনি হিকমতের মালিক এবং সবকিছু সম্পর্কে অবহিত।)

আয়াতসমূহ সুদৃঢ় করার অর্থ, এতে যেসব বিষয় বর্ণিত হয়েছে, দলিল-প্রমাণ দ্বারা তা প্রতিষ্ঠিত। তাতে শব্দগত ও অর্থগত কোনো রকমের ত্রুটি নেই। দ্রষ্টব্য : তাফসীরে আবীস সাউদ ৩/২৮০-২৮১; তাফসীরে উসমানী ২/১১৭; তাফসীরে তাওযীহুল কুরআন ২/৪৫

মোটকথা, কুরআনে কারীম যেমন হক ও সত্যের পক্ষে বস্তুনিষ্ঠ দলিল-প্রমাণ উপস্থাপন করে, যা মন-মস্তিষ্কের গভীরে প্রবেশ করে এবং বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে পরিতৃপ্ত করে। তেমনি আলমাওয়েযাতুল হাসানা-সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে মানুষের আবেগ-অনুভূতির প্রতিও আবেদন জানায়। বাতিল আকীদা-বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণাকে দলিলের ভিত্তিতে খণ্ডন করে এবং বাতিলপন্থীদের সন্দেহ-সংশয়ের সমুচিত জবাব দেয়। তেমনি বাতিল ও গোমরাহির বিরুদ্ধে মানুষের প্রকৃতিতে যে জন্মগত ঘৃণা রয়েছে তাকেও উদ্দীপিত করে এবং সেগুলোর অশুভ পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে। দ্বীন ও শরীয়তকে মনে-প্রাণে গ্রহণ করা এবং সৎকাজে আত্মনিয়োগের আবশ্যকতা ও মাহাত্ম্য যেমন যৌক্তিকভাবে প্রমাণ করে। তেমনি হৃদয়গ্রাহী উপদেশমালার মাধ্যমে সেগুলোর প্রতি আকর্ষণও সৃষ্টি করে।

সূরা নাহলের ১২৫ নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-

اُدْعُ اِلٰی سَبِیْلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَ الْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَ جَادِلْهُمْ بِالَّتِیْ هِیَ اَحْسَنُ.

(তুমি মানুষকে ডাকো তোমার রবের পথে হিকমাহ দ্বারা ও মাওইযায়ে হাসানা দ্বারা এবং ওদের সাথে বিতর্ক করবে এমন পন্থায়, যা অধিকতর সুন্দর।)

এই আয়াতে আল্লাহর পথে ডাকার যে তিনটি উপায় উল্লেখ করা হয়েছে স্বয়ং কুরআনে কারীম সেগুলোর জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত। অধিকন্তু অনেক মুফাসসির বলেছেন যে, উক্ত আয়াতে হিকমাহ ও মাওইযায়ে হাসানা দ্বারা মূলত কুরআনে কারীমকে বুঝানো হয়েছে।

দ্রষ্টব্য : তাফসীরে তবারী ১৪/৪০০; তাফসীরে ইবনে কাসীর ৪/৬১৩; মাআরিফুল কুরআন ৫/৪২০-৪২২

সাত.  যিকর শব্দের একটি অর্থ সুখ্যাতি ও মর্যাদা। সুতরাং কুরআনের ‘আযযিকর’ নামের একটি তাৎপর্য হল, কুরআন মাজীদের প্রতি ঈমান আনা এবং তার বিধান ও শিক্ষা অনুসরণ করা- আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে বিশেষ রহমত ও মর্যাদা লাভের কারণ। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-

فَاسْتَمْسِكْ بِالَّذِیْۤ اُوْحِیَ اِلَیْكَ، اِنَّكَ عَلٰی صِرَاطٍ مُّسْتَقِیْمٍ، وَ اِنَّهٗ لَذِكْرٌ لَّكَ وَ لِقَوْمِكَ، وَ سَوْفَ تُسْـَٔلُوْنَ.

সুতরাং তোমার প্রতি যে ওহী নাযিল হয়েছে তা দৃঢ়ভাবে ধরে রাখ। নিশ্চয়ই তুমি সরল পথে আছ। বস্তুত এ ওহী তোমার ও তোমার কওমের জন্য সুখ্যাতির উপায়। তোমাদের সকলকে জিজ্ঞাসা করা হবে (তোমরা এর কী হক আদায় করেছ)। -সূরা যুখরুফ (৪৩) : ৩৩-৩৪

মনে রাখতে হবে, আল্লাহ তাআলা কোনো কওমকে যেসব বৈশিষ্ট্যের দ্বারা ইজ্জত-সম্মান, প্রভাব ও প্রতিষ্ঠা দান করেন তারা যখন সেসব বিষয়ে উদাসীন ও রিক্তহস্ত হয়ে যায় তখন তাদের প্রভাব ও প্রতিষ্ঠা লুপ্ত হতে থাকে। এই উদাসীনতা যত বেশি হয়, হীনতা ও লাঞ্ছনার আযাবও তত কঠিন হয়ে যায়।

খলীফায়ে রাশেদ হযরত ওমর রা.-এর বাণী স্মরণ করুন। তিনি বলেছিলেন-

إنا كنا أذل قوم أعزنا الله بالإسلام، فمهما نطلب العز بغير ما أعزنا لله به أذلنا الله.

অর্থাৎ আমরা ছিলাম এক লাঞ্ছিত জাতি। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে ইসলামের মাধ্যমে ইজ্জত ও প্রতিষ্ঠা দান করেছেন। সুতরাং আমরা যখনই ভিন্ন কোনো মাধ্যমে ইজ্জত তালাশ করব তখন আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে আবারও লাঞ্ছিত করবেন। -মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ২০৭

আমাদের প্রতি আযযিকর’-এর দাবি

১. কুরআন মাজীদ তিলাওয়াত করা

এটি পবিত্র কুরআনের একটি স্বতন্ত্র হক। এটি আল্লাহ তাআলার শ্রেষ্ঠ যিকির হওয়ার কারণে একটি স্বতন্ত্র এবং অতি বড় ইবাদত। তাই ঈমানদারদের কর্তব্য হল, যথাযথ আদব রক্ষা করে নিয়মিত কুরআনে কারীম তিলাওয়াত করা।

২. কুরআন মাজীদ হিফয করা

কুরআন মাজীদ তিলাওয়াত যেহেতু শ্রেষ্ঠ যিকির ও স্বতন্ত্র ইবাদত, কুরআন যেহেতু সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য অনুসরণীয় উপদেশ বাণী এবং কুরআনই যেহেতু তার অনুসারীদের জন্য মর্যাদা ও সুখ্যাতির কারণ, তাই এই কুরআন চিরস্মরণীয়। তাছাড়া ‘যিকর’ শব্দের অর্থই হচ্ছে স্মরণ করা এবং স্মৃতিতে ধারণ করা। তাই হিফয ও মুখস্থ করার মাধ্যমে কুরআনকে স্মৃতিতে সংরক্ষণ করা কুরআনের একটি স্বতন্ত্র হক।

৩. কুরআনের উপদেশবাণী বোঝার ও হৃদয়ঙ্গম করার চেষ্টা করা

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

كِتٰبٌ اَنْزَلْنٰهُ اِلَیْكَ مُبٰرَكٌ لِّیَدَّبَّرُوْۤا اٰیٰتِهٖ وَ لِیَتَذَكَّرَ اُولُوا الْاَلْبَابِ.

(হে নবী!) এটা এক বরকতময় কিতাব, যা আমি আপনার প্রতি নাযিল করেছি, যাতে মানুষ এর আয়াতসমূহে চিন্তা-ভাবনা করে এবং বোধসম্পন্ন ব্যক্তিগণ উপদেশ গ্রহণ করে। -সূরা ছ¦দ (৩৮) : ২৯

লক্ষণীয়, উপরোক্ত আয়াতে কুরআন সম্বন্ধে তাদাব্বুর এবং ‘তাযাক্কুর’-এর কথা  বলা হয়েছে। তাদাব্বুর মানে চিন্তা-ভাবনা করা। অর্থাৎ উপদেশ গ্রহণের লক্ষে ভক্তি ও ভালোবাসা সহকারে চিন্তা ও ধ্যানমগ্নতার সাথে আয়াত পাঠ করা। ‘তাযাক্কুর’ শব্দের আভিধানিক অর্থ স্মরণ হওয়া বা স্মরণ করা। এখানে উদ্দেশ্য হল, চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমে চেতনা ও উপলব্ধি লাভ করা এবং সেই উপলব্ধি অনুসারে আমল করা।

বস্তুত আল্লাহ তাআলার নেক বান্দাগণ কুরআনের আয়াতসমূহকে আন্তরিক আগ্রহের সাথে গ্রহণ করে। তার বিষয়বস্তু মন দিয়ে শোনে এবং তা যে সত্যের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে চোখ-কান খোলা রেখে তা বোঝার ও হৃদয়ঙ্গম করার চেষ্টা করে। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-

وَ الَّذِیْنَ اِذَا ذُكِّرُوْا بِاٰیٰتِ رَبِّهِمْ لَمْ یَخِرُّوْا عَلَیْهَا صُمًّا وَّ عُمْیَانًا.

এবং যখন তাদের প্রতিপালকের আয়াত দ্বারা তাদেরকে উপদেশ দেওয়া হয় তখন তারা বধির ও অন্ধরূপে তার উপর পতিত হয় না। -সূরা ফুরকান (২৫) : ৭৩

উক্ত আয়াতে মুনাফিকদের কটাক্ষ করা হয়েছে। তারা আল্লাহ তাআলার আয়াত শুনে বাহ্যত তার প্রতি আগ্রহ প্রদর্শন করত এবং তার সামনে এমন বিনীত ভাব দেখাত, মনে হত যেন উপুড় হয়ে পড়ে যাবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সত্য কথা শুনতে তারা মোটেই আগ্রহী ছিল না। সে দিক থেকে তারা চোখ-কান বন্ধ করে অন্ধ ও বধির সদৃশ হয়ে যেত। ফলে কুরআনের আয়াত দ্বারা তারা উপকৃত হতে পারত না। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-

اِنَّ فِیْ ذٰلِكَ لَذِكْرٰی لِمَنْ كَانَ لَهٗ قَلْبٌ اَوْ اَلْقَی السَّمْعَ وَ هُوَ شَهِیْدٌ.

নিশ্চয়ই এর ভেতর এমন ব্যক্তির জন্য উপদেশ রয়েছে, যার আছে অন্তর কিংবা যে মনোযোগ দিয়ে কর্ণপাত করে। -সূরা ক্বাফ (৫০) : ৩৭

৪. কুরআন থেকে উপদশ গ্রহণ এবং কুরআনের হিদায়াত ও বিধানাবলি অনুসরণ

উপদেশ গ্রহণ করাকে কুরআনের ভাষায় তাযাক্কুর বলা হয়। এই অর্থে তাযাক্কুর শব্দটি কুরআনের বহু আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। মনে রাখতে হবে, তাযাক্কুর বা উপদেশ গ্রহণের তিনটি ধাপ রয়েছে :

এক. কোনো উপদেশ ও শিক্ষণীয় বিষয় থেকে সঠিক সমঝ ও উপলব্ধি অর্জন করা।

দুই. উপদেশ অনুসারে আমল করার ব্যাপারে উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা লাভ করা এবং দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হওয়া।

তিন. শিক্ষা ও উপদেশকে কাজে-কর্মে বাস্তবায়ন করা। (দ্রষ্টব্য : মাদারিজুস সালেকীন, ইবনুল কায়্যিম ১/৪৩৯-৪৪৩)

উপরোক্ত তিনটি বিষয় তাযাক্কুর শব্দের অর্থে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।। তবে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে কখনো তিনটি বিষয় একসাথে উদ্দেশ্য হয়। আবার কখনো হয়তো তিনটির কোনো একটি উদ্দেশ্য হয়। পূর্বাপর অবস্থা এবং আনুষঙ্গিক আলামতের ভিত্তিতে তা নির্ধারিত হবে।

যারা ‘যিকর’ তথা কুরআনের উপদেশ গ্রহণ করে তাদের সম্বদ্ধে কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-

اِنَّمَا تُنْذِرُ مَنِ اتَّبَعَ الذِّكْرَ وَ خَشِیَ الرَّحْمٰنَ بِالْغَیْبِ  فَبَشِّرْهُ بِمَغْفِرَةٍ وَّ اَجْرٍ كَرِیْمٍ.

তুমি তো কেবল এমন ব্যক্তিকেই সতর্ক করতে পারো, যে উপদেশ অনুযায়ী চলে এবং দয়াময় আল্লাহকে না দেখে ভয় করে। সুতরাং এরূপ ব্যক্তিকে সুসংবাদ শোনাও মাগফিরাত ও সম্মানজনক পুরস্কারের। -সূরা ইয়াসীন (৩৬) : ১১

আর যারা আল্লাহর উপদেশবাণীকে উপক্ষো করে তাদের সম্বন্ধে কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-

وَ مَنْ اَعْرَضَ عَنْ ذِكْرِیْ فَاِنَّ لَهٗ مَعِیْشَةً ضَنْكًا وَّ نَحْشُرُهٗ یَوْمَ الْقِیٰمَةِ اَعْمٰی،  قَالَ رَبِّ لِمَ حَشَرْتَنِیْۤ اَعْمٰی وَ قَدْ كُنْتُ بَصِیْرًا، قَالَ كَذٰلِكَ اَتَتْكَ اٰیٰتُنَا فَنَسِیْتَهَا  وَ كَذٰلِكَ الْیَوْمَ تُنْسٰی.

আর যে আমার উপদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জীবন  হবে বড় সংকটময়। আর কিয়ামতের দিন আমি তাকে অন্ধ করে উঠাব। সে বলবে, হে রব্ব! তুমি আমাকে অন্ধ করে উঠালে কেন? আমি তো চুক্ষষ্মান ছিলাম। আল্লাহ বলবেন, এভাবেই তোমার কাছে আমার আয়াতসমূহ এসেছিল, কিন্তু তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে। আজ সেভাবেই তোমাকে ভুলে যাওয়া হবে। -সূরা ত্বহা (২০) : ১২৪-১২৬

অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-

وَ مَنْ اَظْلَمُ مِمَّنْ ذُكِّرَ بِاٰیٰتِ رَبِّهٖ فَاَعْرَضَ عَنْهَا وَ نَسِیَ مَا قَدَّمَتْ یَدٰهُ  اِنَّا جَعَلْنَا عَلٰی قُلُوْبِهِمْ اَكِنَّةً اَنْ یَّفْقَهُوْهُ وَ فِیْۤ اٰذَانِهِمْ وَقْرًا  وَ اِنْ تَدْعُهُمْ اِلَی الْهُدٰی فَلَنْ یَّهْتَدُوْۤا اِذًا اَبَدًا.

সেই ব্যক্তি অপেক্ষা বড় জালেম আর কে হতে পারে, যাকে তার প্রতিপালকের আয়াতসমূহের মাধ্যমে উপদেশ দেওয়া হলে সে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং নিজ কৃতকর্মসমমূহ ভুলে যায়। বস্তুত আমি (তাদের কৃতকর্মের কারণে) তাদের অন্তরের উপর ঘেরাটোপ লাগিয়ে দিয়েছি, যদ্দরুন তারা এ কুরআন বুঝতে পারে না এবং তাদের কানে ছিপি এঁটে দিয়েছি। সুতরাং তুমি তাদেরকে হেদায়েতের দিকে ডাকলেও তারা কখনও সৎপথে আসবে না। -সূরা কাহফ (১৮) : ৫৭

সারকথা, বহমান জীবন নদীর তরঙ্গে তরঙ্গে এবং চলমান যাত্রাপথের বাঁকে বাঁকে কুরআনের শিক্ষা ও বিধান স্মরণ করা উলুল আলবাব (বুদ্ধিমান) বান্দাদের জন্য অবশ্য কর্তব্য। যেন যাত্রাপথের কোনো বাঁক এবং জীবন নদীর কোনো তরঙ্গ গাফলত ও বিস্মৃতির অতলে তাকে তলিয়ে দিতে না পারে।

মন্তব্য করুন: