বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, বৈশাখ ১১ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

ইসলাম

কুরআনে কারীম ও সাহাবায়ে কেরাম রাযিয়াল্লাহু আনহুম কিছু দিক কিছু দৃষ্টান্ত

মাওলানা সাঈদ আহমদ

 প্রকাশিত: ১৮:৪১, ১২ নভেম্বর ২০২২

কুরআনে কারীম ও সাহাবায়ে কেরাম রাযিয়াল্লাহু আনহুম কিছু দিক কিছু দৃষ্টান্ত

সাহাবায়ে কেরামের তিলাওয়াত

কুরআনেরঅন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হক হল অধিক পরিমাণে তিলাওয়াত করা। কোনো কোনো দিক থেকে যিকরুল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রকার হল তিলাওয়াত। যারা কুরআনে কারীমের তিলাওয়াতে মশগুল থাকেতাদের প্রশংসায় ইরশাদ হয়েছে-

اِنَّ الَّذِیْنَ یَتْلُوْنَ كِتٰبَ اللهِ وَ اَقَامُوا الصَّلٰوةَ وَ اَنْفَقُوْا مِمَّا رَزَقْنٰهُمْ سِرًّا وَّ عَلَانِیَةً یَّرْجُوْنَ تِجَارَةً لَّنْ تَبُوْرَ   لِیُوَفِّیَهُمْ اُجُوْرَهُمْ وَ یَزِیْدَهُمْ مِّنْ فَضْلِهٖ   اِنَّهٗ غَفُوْرٌ شَكُوْرٌ .

যারা আল্লাহর কিতাব তিলাওয়াত করেনামায কায়েম করে এবং আমি তাদের যা দিয়েছিতা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করেতারা এমন ব্যবসার প্রত্যাশা রাখেযা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার নয়যাতে তিনি তাদেরকে তাদের পুরস্কার পুরোপুরি দান করেন এবং নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে আরো বেশি দেন। নিশ্চয় তিনি অতি ক্ষমাশীলগুণগ্রাহী। -সূরা ফাতির (৩৫) : ২৯-৩০

সূরা আলে ইমরানে আহলে কিতাবের একটি দলের প্রশংসায় ইরশাদ হয়েছে-

(তরজমা) কিতাবীদের মধ্যে একটি দল আছেযারা সঠিক পথের ওপর অধিষ্ঠিতযারা রাতের প্রহরগুলোতে আল্লাহর আয়াতসমূহ পাঠ করে এবং তারা সেজদাবনত থাকে।’ -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১১৩

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসংখ্য হাদীসে কুরআন তিলাওয়াতের সীমাহীন গুরুত্ব ও ফযীলত বর্ণনা করেছেন এবং কুরআন তিলাওয়াতে উদাসীন ব্যক্তিদের নিন্দা করেছেন।

সাহাবায়ে কেরাম রা. তো সবসময় কুরআনী হেদায়াত গ্রহণের জন্য প্রস্তুত থাকতেন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত প্রতিটি আমলের সওয়াব ও ফযীলত অর্জনে পরস্পরে প্রতিযোগিতা করতেন। সুতরাং এসব সওয়াব ও ফযীলতের কথা শোনার পর তাঁদের অবস্থা কেমন হবেতা সহজেই অনুমেয়। তাই তো কুরআন তিলাওয়াতের প্রতি তাঁরা ছিলেন অত্যন্ত আগ্রহী এবং জীবনের বড় একটা অংশ তাঁরা এতেই ব্যয় করতেন। দিনের আলোয় তিলাওয়াত করতেন পরম আগ্রহেআর রাতের প্রহরগুলোতে গভীর নির্জনতায় অনুভব করতেন আরো বেশি আকর্ষণ। ঘরে ও মসজিদেসফরে ও আপন ভূমিতে অবস্থানকালেসব জায়গায় ও সর্বাবস্থায় কুরআন তিলাওয়াতে মশগুল হতেন।

সাহাবায়ে কেরাম নিভৃতে একাকীও তিলাওয়াত করতেনআবার বিভিন্ন সময় মসজিদে সম্মিলিতভাবেও তিলাওয়াত করতেন। হযরত জাবির বিন আবদুল্লাহ রা. বলেনআমরা একবার মসজিদে কুরআন তিলাওয়াত করছিলাম। মজলিসে অনারব ও গ্রাম্য কিছু লোকও ছিল। ইতিমধ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের কাছে উপস্থিত হয়ে মনোযোগ দিয়ে আমাদের তিলাওয়াত শুনতে লাগলেন। তিলাওয়াত শেষ হলে বললেনপড়তে থাকো। সবার পড়াই ভালো। তোমাদের পর এমন সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটবেযারা তীরের মতো সোজা করে (বিশুদ্ধভাবে) কুরআন পড়বে। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য হবে দুনিয়া। ফলে আখেরাতে তারা কোনো সওয়াব লাভ করবে না। -মুসনাদে আহমাদহাদীস ১৫২৭৩সুনানে আবু দাউদহাদীস ৮৩০

এমনিভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার একদল লোককে কুরআন তিলাওয়াত করতে দেখে ইরশাদ করেনআল্লাহ তাআলার শোকরতাঁর কিতাব একটি। কিন্তু তোমাদের মাঝে সাদাকালোলালসব ধরনের লোকই আছে (এবং সবাই তা তিলাওয়াত করে।) -সুনানে আবু দাউদহাদীস ৮৩১

এ হাদীসসহ আরো অন্যান্য হাদীসের ভিত্তিতে ইমাম নববী রাহ. তাঁর বিখ্যাত কিতাব আততিবয়ান’-এ বলেনএকাকী তিলাওয়াতের মতো জামাতবদ্ধ হয়ে কুরআন তিলাওয়াত করাও একটি পছন্দনীয় পদ্ধতি। -আততিবয়ানপৃষ্ঠা ১১৯-১২১

নির্দিষ্ট পরিমাণ তিলাওয়াতের পাবন্দি

কুরআনে কারীমের সাথে সাহাবায়ে কেরামের হৃদয়ের সম্পর্ক কত গভীর ও নিবিড় ছিলতা এ থেকেও বোঝা যায় যেতাঁরা প্রাত্যহিক তিলাওয়াতের জন্য কুরআনের একটি পরিমাণ নির্দিষ্ট করে নিতেন এবং তার পূর্ণ পাবন্দি করতেন। অনেক সাহাবী এ বিষয়ে এত গুরুত্ব দিতেন যেকখনো অপারগতার কারণে তিলাওয়াত ছুটে গেলে পরে তা পূরণ করে নিতেন।

উম্মে মূসা রাহ. বলেনহযরত হাসান ইবনে আলী রা. কুরআন তিলাওয়াতের ওযীফা রাতের শুরু ভাগে আদায় করতেন। আর হযরত হোসাইন রা. আদায় করতেন শেষভাগে। -ফাযায়েলে কুরআনআবু উবায়দ ১/৩৫৭

হযরত আয়েশা রা. বলেনকখনো কখনো এমন হয় যেআমি বিছানায় শুয়ে শুয়েই কুরআন তিলাওয়াতের ওযীফা আদায় করে নিই। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহাদীস ৩০৮০৮আততিবয়াননববীপৃ. ৯৯

প্রসিদ্ধ তাবেঈ ইবরাহীম নাখাঈ রাহ. বলেনকোনো কারণে একদিন কুরআন তিলাওয়াতের ওযীফা ছুটে গেলে পরদিন তা কাযা করে নেয়াই ছিল সালাফের মামুল। উদ্যম থাকলে দিনের বেলায় পড়তেন। নতুবা রাতে তা আদায় করতেন। -ফাযায়েলে কুরআনআবু উবায়দ ১/৩৫৯

তারতীল ও আদব রক্ষা করে তিলাওয়াত

প্রখ্যাত তাবেঈ হযরত আলকামা রাহ. বলেনএকবার আমি সারা রাত ইবনে মাসউদ রা.-এর সাথে নামায পড়েছিলাম। নামাযে তিনি তারতীলের সাথে তিলাওয়াত করছিলেন। আওয়াজ এতটুকু উঁচু ছিল যেমসজিদের অন্যান্য লোকেরা তা শুনতে পাচ্ছিল। -মুখতাসারু কিয়ামিল লাইলপৃ. ১৩১ 

হযরত আবু যামরাহ রাহ. একবার হযরত ইবনে আব্বাস রা.-কে বললেনআমি খুব দ্রুত কুরআন পড়তে পারি। তিনদিনেই খতম করে ফেলি। এ কথা শুনে ইবনে আব্বাস রা. বললেনগড়গড় করে দ্রুত কুরআন খতম করা অপেক্ষা সারা রাতে তারতীল ও তাদাব্বুরের সাথে শুধু সূরা বাকারা তিলাওয়াত করা আমার কাছে অধিক উত্তম মনে হয়। -ফাযায়েলে কুরআনআবু উবায়দ ১/৩২৬আততিবয়াননববীপৃ. ১০৮ফাযায়েলে কুরআনইবনে কাছীরপৃ. ১২৫-১২৬

হযরত আলী রা. থেকে বর্ণিততাদাব্বুর ও চিন্তা-ভাবনাহীন তিলাওয়াতে (পরিপূর্ণ) কল্যাণ নেই। -মুখতাসারু কিয়ামিল লাইলপৃ.  ১৪৮

যারা দ্রুত তিলাওয়াত করে অভ্যস্তবিশেষ করে রমযান মাসে তারাবীহর নামাযে যে সকল হাফেজ ছাহেবান অতি দ্রুত তিলাওয়াত করে থাকেনতাদের জন্য উপরের বর্ণনাবাণী ও ঘটনাগুলোতে অনেক শিক্ষা রয়েছে। তেমনি যাদেরকে আল্লাহ তাআলা কোনো না কোনো পর্যায়ের তাদাব্বুরে কুরআনের যোগ্যতা দিয়েছেনতাদের জন্যও রয়েছে পর্যাপ্ত দিক-নির্দেশনা। আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফীক দান করুনআমীন।

নিভৃত রাতেনামাযে তিলাওয়াত

হযরত আবদুর রহমান ইবনে উসমান তাইমী রাহ. বলেনএকদিন আমি নিয়ত করলামআজ রাতে সবার আগে উঠে মাকামে ইবরাহীমের সামনে সালাত ও ইবাদতে মশগুল হব। সে অনুযায়ী রাতে তাড়াতাড়ি উঠে মাকামে ইবরাহীমের সামনে নামাযে দাঁড়িয়ে গেলাম। হঠাৎ কে যেন আমার পিঠে হাত রাখল। তাকিয়ে দেখিহযরত উসমান ইবনে আফফান রা.। তাঁকে দেখে আমি আমার জায়গা থেকে সরে গেলামআর তিনি নামাযে মশগুল হয়ে গেলেন। আমি দেখলামফজর পর্যন্ত এক রাকাতেই তিনি পুরো কুরআন খতম করে ফেললেন। -ফাযায়েলে কুরআনআবু উবায়দ ১/৩৫১নাতায়েজুল আফকার ৩/১৬০-১৬১

আবু বুরদা ইবনে আবু মূসা আশআরী রা. বর্ণনা করেনএকবার হযরত মুআয ইবনে জাবাল রা. আব্বাজান আবু মূসা আশআরী রা.-কে জিজ্ঞাসা করলেনকুরআন তিলাওয়াতের ব্যাপারে আপনার অভ্যাস কীতিনি বললেনদিনে-রাতে বিভিন্ন সময়ে অল্প অল্প করে তিলাওয়াত করি। আবু মূসা আশআরী রা. তখন জিজ্ঞাসা করলেনআর আপনার অভ্যাস কীমুয়ায রা. বললেনআমি রাতের শুরু ভাগে (কিছুক্ষণ) বিশ্রাম নেই। তারপর জেগে উঠে যতটুকু পারিকুরআন তিলাওয়াত করি। -ফাযায়েলে কুরআনআবু উবায়দ ১/৩৫৮-৩৫৯মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহাদীস ৬৬৭৮

আবু বকর ইবনে হাযম রাহ. বর্ণনা করেনএকদিন রোগীর শুশ্রুষার জন্য হযরত আমরা বিনতে আবদুর রহমান আমাদের ঘরে অবস্থান করলেন। রাতে আমি নামাযে দাঁড়িয়ে নিম্নস্বরে তিলাওয়াত করতে থাকি। সকালে তিনি আমাকে বললেনতুমি উঁচু আওয়াজে কেন তিলাওয়াত করলে না! একটা সময় ছিলযখন আমাদের রাতের বেলা জেগে ওঠার মাধ্যমই ছিল হযরত মুআয ইবনে হারেছ আলকারী এবং আফলাহ-এর তিলাওয়াতের আওয়াজ! -ফাযায়েলে কুরআনআবু উবায়দ ১/৩৪৩

এ পর্যায়ে সাহাবায়ে কেরামের কিছু বাণী উল্লেখ করা যেতে পারেযাতে তাঁরা নিভৃত রাতে কুরআন তিলাওয়াতের উপর জোর দিয়েছেন এবং এ বিষয়ে তাগিদ দিয়েছেন যেএ সময় কুরআন তিলাওয়াত করার দ্বারা যে আত্মিক ফায়দা ও প্রশান্তি লাভ হয় এবং আল্লাহ তাআলার যে সন্তুষ্টি ও নৈকট্য অর্জিত হয়আমরা যেন নিজেদেরকে তা থেকে বঞ্চিত না করি! বিশেষ করে আল্লাহর পক্ষ হতে কুরআনের মতো মহা নেয়ামতপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের এ সময় গাফেল থাকা কিছুতেই উচিত নয়।

হযরত ইবরাহীম নাখাঈ রাহ. বলেনসালাফের যুগে পাবন্দির সাথে রাতের বেলা কুরআন তিলাওয়াত করার প্রতি লোকদের খুব উদ্বুদ্ধ করা হতো। যদিও পরিমাণে তা অল্প হোক না কেন। -আত তিবয়াননববীপৃ. ৮৩

হযরত ইবনে মাসউদ রা. বলেনকুরআন-বাহকের উচিতরাতের বেলা ইবাদত ও তিলাওয়াতে মশগুল থাকাযদিও অন্যরা ঘুমিয়ে থাকে। এবং দিনের বেলা রোযা রাখাযদিও অন্যরা পানাহারে ব্যস্ত থাকে। -ফাযায়েলে কুরআনআবু উবায়দ ১/২৮৯আখলাকু হামালাতিল কুরআনপৃ. ৫০তাফসীরে কুরতুবী ১/৩৮।

কুরআন খতম : সাহাবায়ে কেরামের কর্মপন্থা

কুরআন খতমের মেয়াদের ক্ষেত্রে সাহাবায়ে কেরামের আমল বিভিন্ন রকমের ছিল। কোনো কোনো সাহাবী দুই মাসেকেউবা প্রতি মাসে একবার কুরআন খতম করতেন। কেউ কেউ তো তিন বা চার দিনেই এক খতম তিলাওয়াত করতেন। এছাড়া আরো বিভিন্ন সময়-সীমার কথা সংশ্লিষ্ট কিতাবাদিতে পাওয়া যায়। তবে সাধারণত প্রতি সাত দিনে কুরআন খতম করাই ছিল অধিকাংশ সাহাবীর আমল। -নাতায়েজুল আফকার ১/১৪৪-১৪৬আততিবয়ানপৃ. ৭৫-৭৭ফাযায়েলে কুরআনইবনে কাছীরপৃ. ১৩২-১৩৬আলইতকান ফি উলূমিল কুরআন ১/৩০৩

কুরআন খতমের সময়সীমার ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরামের আমল ভিন্ন ভিন্ন হলেও তাঁদের আদর্শ জীবনে যে বিষয়টি সুস্পষ্ট তা হচ্ছেকুরআন তিলাওয়াতের প্রতি তাঁদের বিপুল আগ্রহ ও অতুলনীয় উদ্দীপনা। প্রতি সাত দিনে একবার খতম করার অর্থ হচ্ছেপ্রতি মাসে চার বার এবং সারা বছরে পঞ্চাশ কিংবা এর চেয়ে বেশি বার পূর্ণ কুরআন তিলাওয়াত করা।

নিম্নে কয়েকজন সাহাবীর নাম ও কুরআন খতমের ক্ষেত্রে তাঁদের রীতি তুলে ধরা হল।

হযরত ওসমান রা.হযরত আবদুল্লাহ বিন মাসউদ রা.হযরত আয়েশা রা.হযরত তামিম দারী রা.হযরত যায়দ বিন ছাবেত রা.-এর ব্যাপারে বর্ণিত আছেতাঁরা প্রতি সাত দিনে এক খতম করতেন। -ফাযায়েলে কুরআনআবু উবায়দ ১/৩৫৮ফাযায়েলে কুরআনইবনে কাছীর ১৩২-১৩৪নাতায়েজুল আফকার ১৪৬-১৪৯আততিবয়ান ৭৯-৮০

প্রসিদ্ধ তাবেঈ আবুল আহওয়াছ বর্ণনা করেনইবনে মাসউদ রা. প্রতি সাত দিনে কুরআন খতম করার জন্য লোকদের তাকিদও করতেন। -নাতায়েজুল আফকার ১/১৪৯

একাধিক বর্ণনায় আছেউবাই ইবনে কাব রা. প্রতি আট দিনে কুরআন খতম করতেন। -ফাযায়েলে কুরআনআবু উবায়দ ১/৩৪৮মুখতাসারু কিয়ামিল লাইলপৃ. ১৫৬নাতায়েজুল আফকার ১/১৪৫

আর হযরত সাঈদ ইবনে মুনযির আনসারী রা. এবং আবু যর  গেফারী রা. প্রতি তিন দিনে কুরআন খতম করতেন। -ফাযায়েলে কুরআনইবনে কাছীর পৃ. ১৩৪নাতায়েজুল আফকার ১/১৫২

এছাড়া আরো একাধিক ছাহাবীর আমল এমনই ছিল। -আততিবয়াননববীপৃ. ৭৬

ইবনে মাসউদ রা. বছরের অন্যান্য মাসে সাত দিনে এক খতম করলেও রমযান মাসে প্রতি তিন দিনে খতম দিতেন। -ফাযায়েলে কুরআনআবু উবায়দ ১/৩৫০মুখতাসারু কিয়ামিল লাইলপৃ. ১৫৫-১৫৬ফাযায়েলে কুরআনইবনে কাছীরপৃ. ১৩৬

আবার কোনো কোনো সাহাবী কখনো কখনো এক রাতে বা এক রাকাতেই পুরো কুরআন খতম করেছেন।

কুরআন খতমের ক্ষেত্রে তাঁরা আরো যেসব বিষয় লক্ষ্য রাখতেন

প্রখ্যাত তাবেঈ আমর ইবনে মুররা রাহ. বলেনসালাফের নিকট পছন্দনীয় ছিল রাতের শুরুভাগে কিংবা দিনের শুরুভাগে কুরআন খতম করা। -আততিবয়ানপৃ. ৮১ইবনে আবু দাউদের সূত্রেনাতায়েজুল আফকার ৩/১৬৭

তাবেঈ মুহাম্মাদ ইবনে জুহাদাহ রাহ. বলেন, (নামাযে কুরআন খতমের ক্ষেত্রে) সালাফের পছন্দনীয় পদ্ধতি ছিলরাতে খতম করলে মাগরিবের পর দুই রাকাতেআর দিনে খতম করলে ফজরের আগে দুই রাকাতে শেষ করা। -ফাযায়েলে কুরআনআবু উবায়দ ১/২৮৬আযযুহদইবনুল মুবারকহাদীস ৭৬০

কুরআন খতমের মজলিস একটি বরকতপূর্ণ মজলিস এবং বিভিন্ন বর্ণনা মোতাবেক তা আল্লাহর রহমতপ্রাপ্তি ও দুআ কবুল হওয়ার বিশেষ মুহূর্ত। -ফাযায়েলে কুরআনআবু উবায়দ ১/২৮৫-২৮৬মুসান্নাফেইবনে আবী শায়বাহাদীস ৩০৬৬৩

তাই সাহাবায়ে কেরাম কুরআন খতমের সময় দোয়ার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। পরিবার-পরিজনকেও তাতে শরিক করতেন। তা ছাড়া কেউ কুরআন খতম করলে তাঁর নিকট গিয়ে তাঁর সাথে দুআয় শরিক হতেন।

ইবরাহীম তাইমী রাহ. থেকে বর্ণিতআবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেনযখন কোনো ব্যক্তি কুরআন খতম করেতখন তাঁর দোয়া কবুল হয়। ইবরাহীম তাইমী রাহ. বলেনএজন্যই আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর অভ্যাস ছিলকুরআন খতম হলে পরিবার-পরিজন সকলকে একত্র করে দুআ করতেন। আর তাঁরা সাথে সাথে আমীন আমীন বলতেন। -ফাযায়েলে কুরআনআবু উবায়দ ১/২৮৬

ইবনে আব্বাস রা.-এর একটি ঘটনা উল্লেখ করে এ আলোচনা শেষ করছি। তিনি কুরআন খতম উপলক্ষে দুআর মজলিসে উপস্থিত হওয়ার প্রতি সবিশেষ যত্নবান ছিলেন। হযরত কাতাদা রাহ. বলেনমদীনার এক ব্যক্তি কুরআনের আশেক ছিল। এজন্য হযরত ইবনে আব্বাস রা. কিছু লোক ঠিক করে রেখেছিলেন যেতাঁরা এই ব্যক্তির প্রতি খেয়াল রাখবে। যখনই তাঁর কুরআন খতমের সময় হতো তাঁরা তাকে খবর দিত এবং তিনি দুআর জন্য তাঁর কাছে গিয়ে উপস্থিত হতেন। -ফাযায়েলে কুরআনআবু উবায়দ ১/২৮৬সুনানে দারেমীহাদীস ৩৪৮৫নাতায়েজুল আফকার ১/১৭২

এ সকল রেওয়ায়াত ও ঘটনাগুলো থেকে কুরআন খতমের সময় দুআ করার এবং সে দুআর মজলিসে শরীক হওয়ার গুরুত্ব ও ফযীলত যেমন বোঝা যায়তেমনি কুরআনের সাথে সাহাবায়ে কেরামের কত গভীর সম্পর্ক ও নিবিড় ভালোবাসা ছিলতাও বোঝা যায়। কুরআনের সাথে সম্পর্ক ও ভালোবাসার এ মহাদৌলত আল্লাহ তাআলা আমাদেরকেও দান করুনআমীন।

সাহাবীগণের তাদাব্বুরে কুরআন

কুরআন মাজীদ হল আল্লাহ তাআলার মহান কালাম। মুজিযাপূর্ণ ঐশী বাণী। যার ইজায তথা অলৌকিকত্বের রয়েছে বহু দিক। একটি বিশেষ দিক হলতার মাঝে রয়েছে অতুলনীয় আকর্ষণ। যা পাঠকের আত্মাকে আকর্ষিত ও হৃদয়কে সম্মোহিত করে। তবে শর্ত হচ্ছেতিলাওয়াত হতে হবে জীবন্ত ও উপলব্ধিপূর্ণ। জাগ্রত হৃদয় নিয়ে ও সজীব আত্মা থেকে।

আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে এ বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে-

وَ اِذَا تُلِیَتْ عَلَیْهِمْ اٰیٰتُهٗ زَادَتْهُمْ اِیْمَانًا وَّ عَلٰی رَبِّهِمْ یَتَوَكَّلُوْنَ.

আর যখন তাদের সামনে কুরআনের আয়াতসমূহ পাঠ করা হয়তখন তা তাদের ঈমান আরো বাড়িয়ে দেয় এবং তাঁরা আপন রবেরই ওপর নির্ভর করে। -সূরা আনফাল (৮) : ২

অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-

اَللهُ نَزَّلَ اَحْسَنَ الْحَدِیْثِ كِتٰبًا مُّتَشَابِهًا مَّثَانِیَ  تَقْشَعِرُّ مِنْهُ جُلُوْدُ الَّذِیْنَ یَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ  ثُمَّ تَلِیْنُ جُلُوْدُهُمْ وَ قُلُوْبُهُمْ اِلٰی ذِكْرِ اللهِ .

আল্লাহ অবতীর্ণ করেছেন উত্তম বাণী তথা এমন কিতাবযার আয়াতগুলো পরস্পর সামঞ্জস্যশীলযার বিভিন্ন বিষয় পুনরাবৃত্ততা শ্রবণ করে যারা তাদের রবকে ভয় করে তাদের লোম দাঁড়িয়ে যায় (ভীত-সন্ত্রস্ত হয়)। এরপর তাদের দেহ-মন বিনম্র হয়ে আল্লাহর স্মরণের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। -সূরা যুমার (৩৯) : ২৩

সাহাবায়ে কেরামের জীবনী পাঠ করলে এ বাস্তবতা স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে যেআল্লাহর পবিত্র কালামের তাদাব্বুরপূর্ণ অর্থাৎ গভীর ধ্যানমগ্নতার সাথে ও চিন্তা-ফিকির করে করে তিলাওয়াতের বিষয়ে তাঁরা কতটা যত্নবান ছিলেন। কুরআনের জীবন্ত তিলাওয়াতের মাধ্যমে হৃদয়কে সজীব ও আত্মাকে আলোকিত করার জন্য তাঁরা কেমন ব্যাকুল ছিলেন। আল্লাহর কালাম তিলওয়াত করে মহব্বত ও ভালবাসায় ভরে উঠত তাঁদের হৃদয়। তাঁরা বিনয়সম্মান ও আবেগ নিয়ে তারতীল ও চিন্তাভাবনার সাথে তিলাওয়াত করে যেতেন। আর ধীরে ধীরে তাঁদের হৃদয় উত্তপ্ত হয়ে উঠত। আর চোখ বেয়ে অঝোরে গড়িয়ে পড়ত অশ্রু!

সাহাবায়ে কেরামের আদর্শ জীবনে রয়েছে এ-সংক্রান্ত অনেক ঘটনা। পাঠকদের সামনে নমুনাস্বরূপ কয়েকটিমাত্র ঘটনা তুলে ধরা হচ্ছে। আল্লাহ তাআলা এ থেকে আমাদের সবাইকে উপকৃত হওয়ার তাওফীক দান করুনআমীন।

আলকামা ইবনে ওয়াককাস রাহ. বর্ণনা করেনএকবার আমি ওমর রা.-এর পিছনে ইশার নামায পড়ছিলাম। তিনি সূরা ইউসুফ তিলাওয়াত শুরু করলেন। যখন ইউসুফ আ.-এর আলোচনা এলতখন এমনভাবে কান্না শুরু করলেন যেশেষ কাতার থেকেও আমি তাঁর কান্নার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম। -ফাযায়েলে কুরআনআবু উবায়দ ১/৩০৮মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক ২/১১১

আবু সালেহ রাহ. বর্ণনা করেনইয়ামানের কিছু লোক আবু বকর রা.-এর কাছে এল। যখন তারা কুরআন তিলাওয়াত শুনলতাদের চোখ থেকে অঝোর ধারায় অশ্রু প্রবাহিত হতে লাগল। এ অবস্থা দেখে আবু বকর রা. বললেনআমাদেরও এমন অবস্থা হত। -ফাযায়েলে কুরআনআবু উবায়দ ১/৩০৬;  আততিবয়ানপৃ. ১০৫

হযরত ইবনে আব্বাস রা. বলেনকুরআন তিলাওয়াতের সময় হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ রা. এতটা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়তেন যেআমি অন্য কাউকে এমন ভীত-সন্ত্রস্ত হতে দেখিনি। -মুখতাসারু কিয়ামিল লাইলপৃ. ১৪৫

সাহাবায়ে কেরামের ঈমানদীপ্ত এই অবস্থার দিকেই হযরত আসমা বিনতে আবু বকর রা. তাঁর একটি বাণীতে ইঙ্গিত করেছেন। একবার তাঁর পৌত্র আবদুল্লাহ ইবনে উরওয়া রাহ. তাঁকে জিজ্ঞেস করলেনকুরআন তিলাওয়াতের সময় সাহাবায়ে কেরামের কী অবস্থা হতআসমা বললেনকিতাবুল্লাহর মধ্যে যে অবস্থা বিবৃত হয়েছে তাঁদের অবস্থা তাই হত। কুরআন তিলাওয়াতকালে তাদের গাল বেয়ে অশ্রু ঝরতআর শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যেত! -আলইতিসামশাতেবী ১/৩৭৪তাফসীরে সাঈদ ইবনে মনসুরের উদ্ধৃতিতে

তিলাওয়াতে তন্ময়তা ও এক আয়াত বারবার পড়া

কুরআন মাজীদের ঐশী প্রভাবের একটি প্রকাশক্ষেত্র হলকুরআন তিলাওয়াতকারী তিলাওয়াত করতে করতে অন্য ভুবনে হারিয়ে যায়। ফলে সে একই আয়াত বারবার পড়তে থাকে। সময়ের স্রোত কোন দিক দিয়ে বয়ে যায়সে তাও অনুভব করতে পারে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর তিলাওয়াতেও এ বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল। (দেখুনসুনানে নাসাঈহাদীস ১০১০সুনানে ইবনে মাজাহহাদীস ১৩৫০ফাযায়েলে কুরআনআবু উবায়দ ১/৩১৪আততিবয়াননববীপৃ ১০৩

আর সাহাবায়ে কেরাম রাযিয়াল্লাহু আনহুমও নবীজীর এ আদর্শের অনুসরণ করেছেন।

আবুদ দুহা রাহ. বর্ণনা করেনএকবার হযরত তামিমে দারি রা. মাকামে ইবরাহীমে দাঁড়িয়ে নামায পড়ছিলেন। তিলাওয়াত করতে করতে সূরা জাছিয়ার এ আয়াতে পৌঁছলেন-

اَمْ حَسِبَ الَّذِیْنَ اجْتَرَحُوا السَّیِّاٰتِ اَنْ نَّجْعَلَهُمْ كَالَّذِیْنَ اٰمَنُوْا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ سَوَآءً مَّحْیَاهُمْ وَ مَمَاتُهُمْ  سَآءَ مَا یَحْكُمُوْنَ۠ 

যারা অসৎকর্ম করেছে ওরা কি মনে করে যেআমি ওদেরকে তাদের সমান করে দেবযারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে, (ফলে) তাদের ও ওদের জীবন ও মৃত্যু হবে একই রকমওরা যে ফয়সালা করেতা কতই না মন্দ। -সূরা জাছিয়া (৪৫) : ২১

তখন তাঁর মাঝে এক বিশেষ অবস্থার সৃষ্টি হল। সকাল পর্যন্ত বারবার তিনি এ আয়াতই তিলাওয়াত করতে থাকলেনআর কাঁদতে থাকলেন। (এক বর্ণনায় এসেছেসেই সাথে রুকু-সেজদাও করছিলেন)। -ফাযায়েলে কুরআনআবু উবায়দ ১/৩১৪-৩১৫মুখতাসারু কিয়ামিল লাইলপৃ. ১৪৯নাতায়েজুল আফকার ৩/১৯১-১৯২

ইবনে আওন রাহ. বলেনএকদিন লোকজন ইবনে মাসউদ রা.-এর রাতের নামায নিয়ে আলোচনা করছিল। তখন এক ব্যক্তি বললইবনে মাসউদ রা. গতকাল রাতে ভোর পর্যন্ত শুধু একটি মাত্র আয়াত বারবার পাঠ করছিলেন। ইবনে আওন রাহ. বলেনসে আয়াতটি হল-

رَبِّ زِدْنِي عِلْمًا

হে প্রভু! আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করে দাও। [সূরা ত্বহা (২০) : ১১৪] -ফাযায়েলে কুরআনআবু উবায়দ ১/৩১৫নাতায়েজুল আফকার ৩/১৯৩

সাহাবায়ে কেরামের অন্তরে কুরআনের প্রতি যে ভালোবাসা ছিল এবং আখেরাতের স্মরণ ও আল্লাহ পাকের ধ্যান তাদের হৃদয়ে যে পরিমাণ জাগ্রত ছিলকুরআনে কারীমের সুচিন্তিত তিলাওয়াতের মাঝে তাঁরা যে পরিমাণ ডুবে থাকতেনএসবেরই অবশ্যম্ভাবী ফলাফল ছিল উপরোক্ত ঘটনাবলী। পবিত্র কুরআনে তাঁদের চিত্রায়ন করা হয়েছে এভাবে-

تَتَجَافَى جُنُوبُهُمْ عَنِ الْمَضَاجِعِ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ خَوْفًا وَطَمَعًا

তাঁদের পার্শ্বদেশ শয্যা থেকে পৃথক থাকেতাঁরা তাদের রবকে ডাকতে থাকেভয় ও আশা নিয়ে।-সূরা সাজদা (৩২) : ১৬

[আলকাউসারের কুরআনুল কারীম সংখ্যায় কুরআনের সাথে সাহাবায়ে কেরামের সম্পর্ক : কিছু দিক কিছু দৃষ্টান্ত’ শিরোনামে লেখকের একটি প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে। মূল প্রবন্ধটির কলেবর বড় হয়ে যাওয়ায় কিছু অংশ তখন রেখে দেওয়া হয়েছিলযাতে পাঠকের জন্য বেশ কিছু উপকারী তথ্য ছিল। বর্তমান সংখ্যায় তারই একটি অংশ প্রয়োজনীয় কিছু সংযোজনসহ পাঠকদের জন্য পেশ করা হল।]

মন্তব্য করুন: