শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, বৈশাখ ১২ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

ইসলাম

শবে বরাত সম্পর্কিত ১০ টি প্রশ্নোত্তর 

 প্রকাশিত: ১০:৩২, ১৮ মার্চ ২০২২

শবে বরাত সম্পর্কিত ১০ টি প্রশ্নোত্তর 

শবে বরাত সম্পর্কিত ১০ টি প্রশ্নোত্তর    
     ১. প্রশ্ন: আমাদের সমাজে এমন কথাও প্রচলিত আছে যে, যে ব্যক্তি মধ্য শাবানের রাতে ১০০ রাকাত সালাত আদায় করবে, প্রত্যেক রাকআতে সুরা ফাতিহা ও ১০ বার সুরা ইখলাস পাঠ করবে সে উক্ত রাতে যত প্রয়োজনের কথা বলবে আল্লাহ তার সকল প্রয়োজন পূর্ণ করবেন। লাওহে মাহফুজে তাকে দুর্ভাগা লিপিবদ্ধ করা হলেও তা পরির্বতন করে সৌভাগ্যবান হিসেবে তার নিয়তি নির্ধারণ করা হবে। আল্লাহ তার কাছে ৭০ হাজার ফিরিশতা প্রেরণ করবেন যারা তার পাপ মুছে দেবেন। বছরের শেষ পর্যন্ত তাকে সুউচ্চ মর্যাদায় আসীন রাখবেন। এছাড়াও আল্লাহ তায়ালা আদন জান্নাতে ৭০ হাজার বা ৭ লক্ষ ফিরিশতা প্রেরণ করবেন যারা জান্নাতের মধ্যে তার জন্য শহর ও প্রাসাদ নির্মাণ করবেন এবং তার জন্য বৃক্ষরাজি রোপন করবেন ...। যে ব্যক্তি এ সালাত আদায় করবে এবং পরকালের শান্তি কামনা করবে আল্লাহ তায়ালা তার জন্য তার অংশ প্রদান করবেন। এখন জানার বিষয় হল, এমন কথা কী সঠিক?
    উত্তর: প্রশ্নে বর্ণিত পদ্ধতির সালাত আদায়ের প্রচলন শুরু হয় হিজরি চতুর্থ শতকের পরে। ধীরে ধীরে তা মানুষের মধ্যে প্রসিদ্ধি লাভ করে। মূলত ৪৪৮ হিজরি সনে প্রথম ফিলিস্তিনের বাইতুল মুকাদ্দাসের মধ্যে শাবানের রাত্রিতে এই পদ্ধতির সালাত আদায় করা হয়। এ সম্পর্কিত (১০০ রাকাত সম্পর্কিত) আরও কয়েকটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। প্রত্যেকটি হাদীস বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। কেউ যদি এমন আমলের কথা বলে তাহলে তার কাছে হাদীসের প্রমাণ চাওয়া উচিত। কিয়ামত পর্যন্ত এমন হাদীস দেখাতে কেউ পারবে না।

২. প্রশ্ন: যে ব্যক্তি মধ্য শাবানের রাতে ৫০ রাকাত সালাত আদায় করবে, সে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার কাছে যত প্রকার প্রয়োজনের কথা বলবে তার সবই পূরণ করে দেয়া হবে। এমনকি লাওহে মাহফুজে তাকে দুর্ভাগ্যবান হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হলেও তা পরিবর্তন করে তাকে সৌভাগ্যবান করা হবে এবং আল্লাহ তাআলা তার কাছে ৭ লক্ষ ফেরেশতা প্রেরণ করবেন যারা তার নেকী লিপিবদ্ধ করবে, অপর ৭ লক্ষ ফেরেশতা প্রেরণ করবেন যারা তার জন্য বেহেশতে প্রাসাদ নির্মাণ করবে .....  এবং আল্লাহকে বিশ^াস করে এমন ৭০ হাজার মানুষের জন্য তার সুপারিশ গ্রহন করা হবে ...। এটি কী সত্য? 
    উত্তর: ইমাম যাহাবী রাহি. বলেন, এই কথাটি জাল। তিনি আরও বলেন যে ব্যক্তি এ হাদীসটি বানিয়েছে আল্লাহ তায়ালা তাকে লাঞ্চিত করুন। এমন কথা কোনো হাদীসে নেই। আজ থেকে যারা এমন কথা বলবে তাদের কাছে হাদীসের রেফারেন্স চাওয়া উচিত। কিয়ামত পর্যন্ত এমন হাদীস দেখাতে কেউ পারবে না।

    ৩. প্রশ্ন: কোন কোন মানুষের মুখ থেকে শোনা যায় যে হযরত আলী রাদি. থেকে বর্ণিত, ‘তিনি বলেন: আমি দেখেছি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মধ্য-শাবানের রাতে ১৪ রাকাত সালাত আদায় করেছেন। তিনি সালাত শেষ করে বসে সূরা ফাতিহা, সূরা ইখলাস এবং সূরা ফালাক ও সূরা নাস প্রত্যেকটি ১৪ বার করে তিলাওয়াত করেছেন। তারপর তিনি একবার আয়াতুল কুরসী এবং সূরা তাওবার শেষের দুটি আয়াত তিলাওয়াত করেছেন। আমি (আলী) তাঁকে এই আমল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন: তুমি আমাকে যেভাবে এই আমল করতে দেখেছ ঠিক সেভাবেই যে এই আমলগুলো করবে তাকে ২০টি কবুল হজে¦র সওয়াব দেওয়া হবে। ২০ বছরের কবুল সিয়াম পালনের সওয়াব দেওয়া হবে। আর যদি সে পরদিন সিয়াম পালন করে তাহলে তাকে দুই বছরের সিয়াম পালনের সওয়াব দেওয়া হবে।’ এখন জানার বিষয় হল, এটি নাকি ইমাম বাইহাকী তার কিতাবের উল্লেখ করেছেন? এমন কথা কতটুকু সত্য? হাদীসে থাকলে রেফারেন্সসহ জানাবেন।
    উত্তর: এই হাদীসটি ইমাম বাইহাকী রাহি. তার কিতাবে উল্লেখ করেছেন এবং তিনি এ কথাও বলেছেন: ইমাম আহমদ রাহি. বলেছেন যে, এই হাদীসটি আপত্তিকর, বানোয়াট ও জাল বলে প্রতীয়মান হয়। আল্লামা ইবনুল জাওযী এবং জালালুদ্দীন সুয়ূতী রাহি. বলেন: হাদীসটি বানোয়াট। এর সনদ অন্ধকারাচ্ছন্ন। ইমাম আহমদ রাহি. বলেন: এর সনদের মধ্যে মুহাম্মদ বিন মুহাজির রয়েছেন। তিনি হাদীস বানোয়াটকারী। সুতরাং এমন জাল এবং বানোয়াট হাদীস দিয়ে দলিল-প্রমাণ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

    ৪. প্রশ্ন: অনেকের মুখে এ কথাও শুনা যায় যে, শবে বরাতে চার রাকাত করে মোট আট রাকাত নামায পড়তে হয়। প্রতি রাকাতে সূরা ফাতিহার পর সূরা কদর (ইন্না আংযালনা) একবার এবং সূরা ইখলাস পচিঁশবার পড়তে হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি এভাবে সালাত আদায় করবে তার সকল গুনাহ মাফ হয়ে যাবে এবং সে সদ্যপ্রসূত শিশুর ন্যায় নিষ্পাপ হয়ে যাবে। এমন কথা কুরআন-হাদীসে কোথাও আছে কী?
    উত্তর: এমন কথা অবশ্যই ভ্রান্ত এবং মনগড়া কথা।। এ ধরণের কথা কুরআন-হাদীসের কোথাও নেই। এ সব বানোয়াট কথা। কারণ, এগুলোর পক্ষে কুরআন-হাদীসের কোন দলিল-প্রমাণ কেউ দেখাতে পারবে না। সুতরাং যারা এমন কথা বিশ্বাস করে তাদের গুনাহ হবে। তাদেরকে ভালকরে মনে রাখা উচিত। 
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন-
আমি যা বলিনি (অর্থাৎ যা হাদীস নয়) তা যদি আমার নামে কেউ প্রচার করে তাহলে সে যেন জাহান্নামে তার ঘর তৈরী করে নেয়। সহীহ বুখারী, হাদীস- ১২৯১; সহীহ মুসলিম, হাদীস- ৪; আবু দাউদ, হাদীস- ৩৬৫৩    
সুতরাং আপনার শোনা কথাটি সঠিক নয়। 

    ৫. প্রশ্ন: পাঁচটি রাত্রি ইবাদতে জেগে থাকার ফযীলত সম্পর্কিত হাদীস কতটুকু নির্ভরযোগ্য? 
    উত্তর: এ সম্পর্কিত একটি বানোয়াট হাদীস বর্ণিত আছে। আমরা প্রথমে হাদীসটি উল্লেখ করব তারপর হাদীসটির নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে আলোচনা করব। হাদীসটি মুয়ায ইবনু জাবাল রাদি. -এর সূত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামে বর্ণিত হয়েছে:
যে ব্যক্তি পাঁচ রাত (ইবাদতে) জাগ্রত থাকবে তার জন্য জান্নাত পাওয়া অবধারিত হবে: ১. যিলহজ্জ মাসের ৮ তারিখের রাত্রি,  ২. যিলহজ্জ মাসের ৯ তারিখের  (আরাফার) রাত্রি, ৩. যিলহজ্জ মাসের ১০ তারিখের (ঈদুল আযহার) রাত্রি, ৪. ঈদুল ফিতরের রাত্রি ও ৫. মধ্য শাবানের রাত্রি। 
সূরা দুখানের প্রথম চারটি আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীরে রুহুল বয়ানেও হাদীসটি উল্লেখ হয়েছে। তবে হাদীসটি মাওযূ বা জাল। কারণ হাদীসটির সনদের মধ্যে আব্দুর রাহীম ইবনু যাইদ আলআম্মী (১৮৪ হি.) রয়েছেন। তিনি জাল-হাদীস বর্ণনাকারী বলে প্রসিদ্ধ ছিলেন। ইমাম বুখারী, নাসাঈ, ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন, আহমদ ইবনু হাম্বাল, আবূ দাঊদ ব্যক্তির মিথ্যাবাদিতার বিষয় উল্লেখ করেছেন। এজন্য এ হাদীসটি মাওযূ বা জাল হাদীস বলে গণ্য। 

    ৬. প্রশ্ন: মধ্য শাবানের রাত্রিতে রহমতের ৩০০ দরজাগুলো খোলা হয়। এটি কী হাদীস? 
    উত্তর: উবাই ইবনু কাব রাদি. এর সূত্রে কথিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন-
মধ্য শাবানের রাত্রে জিবরাঈল আলাইহিস সালাম আমার নিকট আগমন করে বলেন, আপনি দাঁড়িয়ে সালাত পড়–ন এবং আপনার মাথা ও হস্তদ্বয় উপরে উঠান। আমি বললাম, হে জিবরাঈল, এটি কোন রাত? তিনি বলেন, হে মুহাম্মাদ, এ রাতে আসমানের দরজা সমূহ খুলে দেওয়া হয় এবং রহমতের ৩০০ দরজা খুলে দেওয়া হয়। ... তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাকী গোরস্থানে গমন করেন। তিনি যখন সেখানে সাজদারত অবস্থায় দুআ করছিলেন, তখন জিবরাঈল সেখানে অবতরণ করে বলেন, হে মুহাম্মাদ, আপনি আকাশের দিকে মাথা তুলুন। তিনি তখন তাঁর মস্তক উত্তোলন করে দেখেন যে, রহমতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়েছে। প্রত্যেক দরজায় একজন ফিরিশতা ডেকে বলছেন, এই রাত্রিতে যে সাজদা করে তার জন্য মহা সুসংবাদ...।
হাদীসটি উল্লেখ করে আবুল হাসান আলী ইবনু মুহাম্মদ ইবনু ইরাক আল-কিনানী (৯৬৩ হি.) বলেন, এ হাদীসটি একটি মাত্র সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। সে সূত্রে উল্লেখিত বর্ণনাকারীগণ সকলেই অজ্ঞাত পরিচয়। ফলে হাদীসটি বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। আশা করি বুঝতে অসুবিধা হয় নি।

    ৭. প্রশ্ন: মধ্য শাবানের রাতের ইবাদত চারশত বছরের ইবাদতের সমান। এই মর্মে হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম সম্পর্কিত যে ঘটনা সমাজে প্রচারিত আছে তা কী সত্য? 
    উত্তর: এই মর্মে হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম সম্পর্কিত একটি ঘটনা কালইউবী কিতাবে বর্ণিত আছে। ঘটনা হচ্ছে, একদা হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম ভ্রমণে বের হলেন। তিনি এক সুউচ্চ পাহাড় দেখতে পেয়ে সেদিকে অগ্রসর হলেন। হঠাৎ করে পাহাড়ের চূড়ায় একটি শক্ত পাথর তাঁর দৃষ্টিগোচর হলো। যা দুধের চেয়েও শুভ্র-স্বচ্ছ। তার চারপাশে তিনি হাঁটতে লাগলেন এবং তার সৌন্দর্যে অভিভূত হতে লাগলেন। আল্লাহপাক তাঁর নিকট ওহী প্রেরণ করলেন, হে ঈসা! তুমি যা দেখছো এর চেয়েও বিস্ময়কর বিষয় আমি তোমার সামনে প্রকাশ করবো। তুমি কী তা পছন্দ করো? ঈসা আলাইহিস সালাম বললেন: হ্যাঁ, হে আমার প্রভু! আপনি তা করুন। পাথরটি তখন ফেটে গেলো। তিনি তার মধ্যে একজন বুযুর্গ ব্যক্তিকে দেখতে পেলেন। তার পরনে রয়েছে পশমি জুব্বা। তার হাতে একটি সবুজ ছড়ি। তার দুচোখের সামনে রয়েছে আঙ্গুর। আর সে বুযুর্গ দাঁড়িয়ে নামায পড়ছেন। হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম অনেক বিস্মিত হয়ে বললেন: হে শায়খ! আমি একি দেখছি? শায়খ বললেন: এটা আমার দৈনন্দিনের রিযিক। হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম তাঁকে বললেন: আপনি কত দিন পর্যন্ত এই পাথরের মধ্যে উপাসনায় রয়েছেন? তিনি বললেন, চারশ বছর ধরে। হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম বলে উঠলেন, হে আমার মাবুদ! হে আমার প্রভু! আমি বলতে পারি না যে, আপনি এর চেয়ে কোনো উত্তম মাখলুক আর সৃষ্টি করেছেন কিনা? আল্লাহ ওহী পাঠালেন, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মতের যে কেউ শাবান মাস পায় আর সে উক্ত মাসের ১৫ তারিখের রজনীতে ইবাদত করে তা আমার নিকট চারশত বছর ইবাদতের চেয়েও উত্তম। এ কথা শোনে হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম বললেন: হায়! যদি আমি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মত হতাম। কালয়ূবী (আরবি-বাংলা), সম্পাদনা ও সংযোজনা: মাওলানা হাফিজুর রহমান যশোরী, আল-আকসা লাইব্রেরী, ৫০ বাংলা বাজার, ঢাকা-১১০০  
প্রিয় পাঠক/পাঠিকা! যেই কালয়ূবী কিতাবে ঘটনাটি উল্লেখ করা হয়েছে সেই কিতাবটি আমাদের বাংলাদেশের কওমী মাদরাসার অষ্টম/নবম শ্রেণির সিলেবাসের পাঠ্য কিতাব। মূলত কিতাবটি থেকে কোনো হাদীস বা ইতিহাস শেখানোর উদ্দেশ্যে সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত করা হয় নি। বরং এই কিতাবটি থেকে আরবি সাহিত্য শেখানো মূল উদ্দেশ্য। কিতাবটিতে এমন আরও কিছু ইসরায়েলী বর্ণনা উল্লেখ করা হয়েছে। যা সাধারণত বা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জাল এবং ভিত্তিহীন। সুতরাং এ সব কিতাবের উদ্ধৃতি দিয়ে ততক্ষণ পর্যন্ত আমল করার সুযোগ নেই, যতক্ষণ পর্যন্ত তা আমলযোগ্য হাদীস সমর্থিত না হবে। তবে উত্তম হচ্ছে এ সব কিতাবের পরিবর্তে আরও উন্নত সাহিত্য এবং ঐতিহাসিক বিবেচনায় গ্রহণযোগ্য সেগুলো সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত করা। বিশেষ করে কুরআন-হাদীসের সাহিত্য শেখার সহায়ক গ্রন্থ বেশি উত্তম। 

    ৮. প্রশ্ন: আমরা শুনেছি হাদীসের মধ্যে মধ্য শাবানের রাত্রিতে চলতি বছরে জন্ম-গ্রহণকারী এবং মৃত্যুবরণকারী আদম সন্তানদের নাম লিপিবদ্ধ করা হয়। এ রাতে আদম সন্তানদের আমল উপরে উঠিয়ে নেয়া হয় এবং তাদের রিযিক অবতীর্ণ হয়। কথাটি কতটুকু সত্য?
    উত্তর: এ ধরণের হাদীস কোনো কোনো কিতাবে উল্লেখ আছে। যেমন-
এ রাতে চলতি বছরে জন্ম-গ্রহণকারী আদম সন্তানদের নাম এবং চলতি বছরে মৃত্যুবরণকারী আদম সন্তানদের নাম লিপিবদ্ধ করা হয়। এ রাতে আদম সন্তানদের আমল উঠিয়ে নেয়া হয় এবং তাদের রিযক অবতীর্ণ হয় ...। মিশকাতুল মাসাবীহ, হাদীস- ১৩০৫
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আয়েশাকে বললেন, তুমি কী জানো আজকের রাত্রিটি কোন রাত্রি? আয়েশা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! এ রাত্রে কী আছে? তখন তিনি উপরে উল্লেখিত কথাগুলো বললেন। হাদীসটি মিশকাতুল মাসাবীহ গ্রন্থে খতীব তাবরিযী (৭৫০ হি.) উদ্ধৃত করেছেন। তিনি ইমাম বায়হাক্বীর আদ-দাওয়াতুল কাবীর নামক গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে হাদীসটি সংকলন করেছেন। হাদীসটির সনদে একজন অজ্ঞাত পরিচয় বর্ণনাকারী আছেন। এছাড়া হাদীসটির মূল বর্ণনাকারী হলেন আন-নাদ্র ইবনু কাসীর”। তিনি ইয়াহইয়া ইবনু সাদ থেকে, তিনি উরওয়া ইবনু যুবাইর থেকে তিনি আয়েশা রাদি. থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
আন-নাদর ইবনু কাসীর সম্পর্কে হাদীস বিশারদগণের অভিমত:
ইবনু হাজার বলেন: আন-নাদ্র ইবনু কাসীর তাবি-তাবিয়ী যুগের একজন রাবী। মুহাদ্দিসগণ তাকে দুর্বল বলেছেন। ইমাম আহমদ বলেন: এ ব্যক্তি হাদীস বর্ণনায় দুর্বল। ইমাম বুখারী বলেন: সে অত্যন্ত দুর্বল বা মুনকার হাদীস বর্ণনা করেছে। তার বিষয়ে আপত্তি রয়েছে। ইমাম নাসাঈ বলেন: লোকটি চলনসই। ইমাম ইবনু হিব্বান বলেন: এ ব্যক্তি নির্ভরযোগ্য রাবীদের থেকে জাল হাদীস বর্ণনা করতেন। উকাইলী, দোলাবী ও অন্যান্য মুহাদ্দিসও তাকে দুর্বল ও অনির্ভরযোগ্য বলে উল্লেখ করেছেন। 
এমন দূর্বল হাদীসের মাধ্যমে কুরআনের স্পষ্ট আয়াত এবং সহীহ হাদীসের বিপক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। কুরআনে বলা হয়েছে মানুষ সৃষ্টির আরও অনেক আগেই তাদের জীবন-মৃত্যু এবং রিযিক নির্ধারণ করা হয়েছে। 
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-
তারা যা কিছু করেছে, সবই আমলনামায় আছে। প্রতিটি ছোট ও বড় বিষয় লিপিবদ্ধ আছে। সূরা কামার, আয়াত- ৫২-৫৩
হাদীসে এসেছে-
মহান আল্লাহ আসমান-জমিন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর পূর্বেই তাঁর সকল সৃষ্টির ভাগ্য (জীবন-মৃত্যু, রিযিক ইত্যাদি) লিখে রেখেছেন। সহীহ মুসলিম, হাদীস- ৬৯১৯
অতএব এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, মধ্য শাবানের রাত্রিতে চলতি বছরে জন্ম-গ্রহণকারী এবং মৃত্যুবরণকারী আদম সন্তানদের নাম লিপিবদ্ধ করা হয়। এ রাতে আদম সন্তানদের আমল উপরে উঠিয়ে নেয়া হয় এবং তাদের রিযক অবতীর্ণ হয় কথাটি গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, এমন কথা কুরআনের আয়াত এবং অসংখ্য সহীহ হাদীসের সম্পূর্ণ বিপরীত। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক বুঝার তাওফিক দান করুন।

    ৯. প্রশ্ন: আমাদের সমাজের কিছু সাধারণ আলেম-উলামা এবং জনসাধারণের মুখ থেকে শোনা যায় যে মধ্য শাবানের রাতে মালাকুল মাউতকে মৃতদের নাম জানানো হয় এবং ভাগ্য নির্ধারণ করা হয়। এমন কথা কতটুকু গ্রহণযোগ্য?
    উত্তর: এমন একটি কথা হাদীসে আছে। তবে হাদীসটি দূর্বল। কুরআন এবং অন্যান্য সহীহ হাদীস বিরোধী। এখানে আমরা প্রথমে হাদীসটি উল্লেখ করে তার দূর্বলতার কারণ আলোচনা করব। হাদীসটি তাবিয়ী রাশিদ ইবনু সাদ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন
মধ্য শাবানের রাতে মহান আল্লাহ মৃত্যুর ফিরিশতাকে উক্ত বছরে যাদের মৃত্যু নির্ধারিত তাদের সম্পর্কে অবহিত করেন। আল-জামিউস সাগির, হাদীস- ৫৯৬৪ 
হাদিসটি ইমাম সুয়ুতী (৯১১ হি.) ইমাম দীনাওরীর আল-মুজালাসা গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে তাঁর আল-জামি আস-সাগীর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, হাদীসটি দীনাওরী রাশিদ ইবনু সাদ থেকে মুরসালরূপে সংকলন করেছেন। এমন মুরসাল হাদীসের মাধ্যমে কুরআনের স্পষ্ট আয়াতের বিপক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। কুরআনে বলা হয়েছে মানুষ সৃষ্টির আরও অনেক আগেই তাদের জীবন-মৃত্যু এবং রিযিক নির্ধারণ করা হয়েছে। 
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-
وَكُلُّ شَيْءٍ فَعَلُوهُ فِي الزُّبُرِ (৫২) وَكُلُّ صَغِيرٍ وَكَبِيرٍ مُسْتَطَرٌ (৫৩)
তারা যা কিছু করেছে, সবই আমলনামায় আছে। প্রতিটি ছোট ও বড় বিষয় লিপিবদ্ধ আছে। সূরা কামার, আয়াত- ৫২-৫৩
হাদীসে এসেছে-
 (হযরত আদম আলাইহিস সালাম হযরত মূসা আলাইহিস সালামকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন) আপনি এমন একটি বিষয়ে কেন আমাকে অভিযুক্ত করছেন, আমাকে সৃষ্টি করারও আগে যেটির সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ে গিয়েছে।) সহীহ বুখারী, হাদীস- ৩৪০৯/৭৫১৫; সহীহ বুখারী, ই.ফা. হাদীস- ৭০০৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস- ৬৯১৫
হাদীসে এসেছে-
মহান আল্লাহ আসমান-জমিন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর পূর্বেই তাঁর সকল সৃষ্টির ভাগ্য (জীবন-মৃত্যু, রিযিক ইত্যাদি) লিখে রেখেছেন। সহীহ মুসলিম, হাদীস- ৬৯১৯
অতএব এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, আমাদের সমাজের কিছু সাধারণ আলেম-উলামা এবং জনসাধারণের মুখ থেকে মধ্য শাবানের রাতে মালাকুল মাউতকে মৃতদের নাম জানানো হয় এবং ভাগ্য নির্ধারণ করা হয়। এমন কথা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, তা কুরআনের আয়াত এবং অসংখ্য সহীহ হাদীসের সম্পূর্ণ বিপরীত। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক বুঝার তাওফিক দান করুন।

    ১০. প্রশ্ন: মধ্য শাবানের রাতে মসজিদে একত্রিত হওয়া এবং ইবাদত  করার  ব্যপারে  ইসলামের  বিধান  কী?
    উত্তর: প্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ আল্লামা হাসান ইবনু আম্মার শুরুম্বুলালী (১০৬৯ হি.) বলেন: দুই ঈদের রাত্রি, যিলহাজ্জ মাসের দশ রাত্রি ও মধ্য-শাবানের রাত্রি ইবাদত বন্দেগিতে কাটানো মুস্তাহাব, তবে এজন্য মসজিদে বা অন্য কোথাও সমবেত হওয়া মাকরূহ। তিনি বলেন: 
ويكره الاجتماع على إحياء ليلة من هذه الليالي ...... في المساجد وغيرها لأنه لم يفعله النبي صلى الله عليه و سلم ولا الصحابة
এ সকল রাত্রি ইবাদতে কাটাতে মসজিদে বা অন্য কোথাও সমবেত হওয়া মাকরূহ; কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরূপ করেন নি, এবং তাঁর সাহাবিগণও এরূপ করেন নি। নুরুল ঈযাহ; মারাকিউল ফালাহ এবং কানযুদ দাকায়েকের ব্যাখ্যাগ্রন্থ আল-বাহরুর রায়েক
শবেবরাতে জাগ্রত থেকে ইবাদত করা একটি মুস্তাহাব আমল। এর জন্য মানুষকে মসজিদে দলবদ্ধ করা এবং দলবদ্ধতার সাথে ইবাদত করার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে অন্যকেও অংশ গ্রহনের জন্য আহবান করা উলামায়ে কেরাম পছন্দ করেন নি, বরং একে বিদআত বলেছেন। এমনিভাবে দলবদ্ধভাবে কবর যিয়ারত করাও বিদআত। কবর যিয়ারত করতে চাইলে একাকীভাবে কবর যিয়ারত করবে। ফজিলতময় রাত সমূহে মসজিদে একত্রিত হয়ে ইবাদত করার ব্যপারে হানাফী মাযহাবের ব্যরিস্টার আল্লামা ইবনুল নুজাইম রাহিমাহুল্লাহু তায়ালা পরিস্কারভাবে লিখেছেন-
ويكره الاجتماع على إحياء ليلة من هذه الليالي في المساجد
ফযিলতময় রাত সমূহে ইবাদত করার নিমিত্তে দলবদ্ধ হওয়া মাকরূহ মসজিদে হোক বা অন্যত্র। আল-বাহরুর রায়েক, ২/৫২ 

প্রতিটি মুমিনের প্রতি আমাদের শেষ কথা:
মধ্য শাবানের রাতে যে ক্ষমা পাওয়ার কথা বলা হয়েছে, তা প্রতি বছরে শুধু একরাতে। মধ্য শাবানের রাতে ক্ষমা প্রাপ্তির কথা যে সব হাদীসে বলা হয়েছে সে সব হাদীসের বিশুদ্ধতা নিয়েও অনেক মতানৈক্য রয়েছে। অথচ বিশুদ্ধ হাদীসে প্রতিটি মুমিনকে অনেক বড় সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ প্রতিটি রাতে তার বান্দার সমস্যার সমাধান এবং গুনাহ থেকে মুক্তি লাভের জন্য সুবর্ণ সুযোগ দান করেন। 
হাদীসে এসেছে-
يَنْزِلُ رَبُّنَا تَبَارَكَ وَتَعَالَى كُلَّ لَيْلَةٍ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا حِينَ يَبْقَى ثُلُثُ اللَّيْلِ الْآخِرُ يَقُولُ مَنْ يَدْعُونِي فَأَسْتَجِيبَ لَهُ مَنْ يَسْأَلُنِي فَأُعْطِيَهُ مَنْ يَسْتَغْفِرُنِي فَأَغْفِرَ لَهُ 
আমাদের প্রতিপালক প্রতি রাতের যখন শেষ তৃতীয়াংশ থাকে তখন পৃথিবীর আসমানে অবতরণ করেন। আর বলেন, আমার কাছে যে দুআ করবে আমি তার দুআ গ্রহণ করব। আমার কাছে যে চাইবে আমি তাকে দান করব। আমার কাছে যে ক্ষমা প্রার্থনা করবে আমি তাকে ক্ষমা করব। সহীহ বুখারী, হাদীস- ১১৪৫, ৬৩২১ এবং ৭৫৯৫
সহীহ বুখারী এবং মুসলিমে বর্ণিত হাদীস থেকে জানা গেছে যে, মহান আল্লাহ প্রতি রাতে তার বান্দাদের গুনাহ মাফ করাসহ বান্দার সকল সমস্যার সমাধানের জন্য তিনি এই পৃথিবীর আসমানে অবতরন করেন। সুতরাং মধ্য শাবানের রাতের অপেক্ষা না করে আমরা প্রতিটি রাতেই মহান আল্লাহর কাছে আমাদের গুনাহ এবং যাবতীয় সমস্যার সমাধানের জন্য বিনীত আবেদন করবো। মধ্য শাবানের রাতের জন্য অপেক্ষা করবো না। কারণ, মধ্য শাবানের রাত পর্যন্ত হায়াত পাবো কিনা তা বলা যায় না। মহান আল্লাহ আমাদেরকে প্রতিটি রাতেই বেশি করে আমল করার তাওফিক দান করেন। আমীন।

মন্তব্য করুন: