শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, বৈশাখ ৬ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

ইসলাম

শাবান রমযান ঈদ: কিছু নিবেদন

মুহাম্মাদ আশিক বিল্লাহ তানভীর

 আপডেট: ০০:৪৯, ১৬ এপ্রিল ২০২২

শাবান রমযান ঈদ: কিছু নিবেদন

আল্লাহ তাআলার অপার মেহেরবানী, তিনি আমাদেরকে ১৪৪৩ হিজরীর শাবান-রমযানে উপনীত করেছেন আলহামদু লিল্লাহ। আল্লাহর দরবারে প্রত্যাশা রাখি পরিবার-পরিজন নিয়ে শান্তি-নিরাপত্তা ও আনন্দের সাথে ঈদুল ফিত্র উদ্যাপনের। এটা আল্লাহ তাআলার অনেক বড় নিআমত। একজন মুমিনের ঈমানী কর্তব্য হল, আল্লাহর নিআমতের শুকরিয়া আদায় করা। এই শুকরিয়া আদায়ের একটি মাধ্যম এবং প্রকাশ হল, আল্লাহর দেওয়া নিআমত আল্লাহর হুকুম ও সন্তুষ্টি মোতাবেক ব্যবহার করা।

একটি বছর যায়, একটি বছর আসে। একটি রমযান যায়, একটি রমযান আসে। এভাবে জীবনও একদিন ফুরিয়ে যাবে, আমি উপনীত হব জীবনের শেষ রমযানে; যে রমযানের পর আর রমযান আসবে না আমার জীবনে। কিন্তু আমি জানি না কোন্ রমযান আমার জীবনের শেষ রমযান। হয়ত এই রমযান...! আসুন, রমযানের যথাযথ কদর করি। সামনে দীর্ঘ বন্ধুর পথ, পাথেয় সংগ্রহের এখনই সময়!

সৌভাগ্যবান ব্যক্তি তো সে, যে প্রতিটি রমযানেরই যথাযথ কদর করল এবং আল্লাহর দেওয়া মূল্যবান মুহূর্তগুলো থেকে অধিকতর ঈমানী-রূহানী ও পরকালীন পাথেয় সংগ্রহ করল।

কীভাবে আমার রমযান, রমযান পূর্ববর্তী শাবান এবং রমযান পরবর্তী ঈদ ফলপ্রসূ হতে পারে বক্ষমাণ প্রবন্ধে এব্যাপারে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করার চেষ্টা করা হবে ইনশাআল্লাহ।

শাবান মাস : গুরুত্ব ও ফযীলত

মুমিনের কাঙ্খিত রমযান মাসের পূর্ববর্তী মাসের নাম শাবান। দ্বীনী বিবেচনায় এই মাসটি অত্যন্ত তাৎপর্য ধারণ করে। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গুরুত্বের সাথে এ মাসে আমল করতেন।

নবীজী যে মাসে বেশি বেশি রোযা রাখতেন

শাবান মাস এলে নবীজী অধিকহারে রোযা রাখতেন। আম্মাজান হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা. বলেন

مَا رَأَيْتُ رَسُولَ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ اسْتَكْمَلَ صِيَامَ شَهْرٍ قَطّ إِلاّ رَمَضَانَ وَمَا رَأَيْتُهُ فِي شَهْرٍ أَكْثَرَ مِنْهُ صِيَامًا فِي شَعْبَانَ.

আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রমযান ব্যতীত পূর্ণ মাস রোযা রাখতে দেখিনি। আর শাবান মাস অপেক্ষা অন্য মাসে অধিক রোযা রাখতে তাঁকে দেখিনি। সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬৯১

হযরত আয়েশা রা. আরো বলেন

كَانَ أَحَبّ الشّهُورِ إِلَى رَسُولِ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ أَنْ يَصُومَهُ شَعْبَانَ...

অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট প্রিয় আমল ছিল শাবান মাসে রোযা রাখা...। মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৫৫৪৮; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৪৩১

ইমাম ইবনে রজব হাম্বলী রাহ. বলেন, ফরয নামাযের আগে-পরে যেভাবে সুন্নত-নফলের বিধান রয়েছে, তেমনি রমযানের আগে-পরে শাবান ও শাওয়াল মাসে রোযার বিধান রয়েছে মূল বিধানের পরিপূরক হিসাবে। তাই মূল ইবাদতের পাশাপাশি পূর্বাপরের নফল ইবাদতগুলোর প্রতিও যতœবান হওয়া চাই। (দ্রষ্টব্য : লাতায়েফুল মাআরেফ, পৃ. ১৮৮)

এ হিসাবে পয়লা শাবান থেকে সাতাশ শাবান পর্যন্ত রোযা রাখার বেশ গুরুত্ব রয়েছে। হাদীস শরীফে শাবানের শেষ দুয়েকদিন রোযা রাখতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে রমযানের প্রস্তুতি নেওয়ার লক্ষে। (দ্রষ্টব্য : সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯১৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০৮২)

লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান : ফযীলতপূর্ণ এক রজনী

অর্ধ শাবানের রজনী তথা চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতের রয়েছে বিশেষ তাৎপর্য। হাদীসের ভাষায় ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’। প্রচলিত ভাষায় আমরা যাকে ‘শবে বরাত’ বলে ব্যক্ত করি। হাদীসে এ রাতের বিশেষ ফযীলতের বিবরণ এসেছে।

হযরত মুআয ইবনে জাবাল রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন

يَطْلُعُ اللهُ إِلَى خَلْقِهِ فِي لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ فَيَغْفِرُ لِجَمِيعِ خَلْقِهِ إِلّا لِمُشْرِكٍ أَوْ مُشَاحِنٍ.

অর্ধ শাবানের রাতে আল্লাহ সৃষ্টির প্রতি (রহমতের বিশেষ) দৃষ্টি প্রদান করেন। অতঃপর শিরককারী ও বিদ্বেষপোষণকারী ছাড়া সমগ্র সৃষ্টিকে ক্ষমা করে দেন। সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৫৬৬৫

এছাড়া আরো বহু হাদীসে লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান বা শবে বরাতের কথা এসেছে। সুতরাং এটি একটি ফযীলতপূর্ণ রজনী।

শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহ. বলেছেন

‘পনেরো শাবানের রাতের ফযীলত সর্ম্পকে একাধিক ‘মারফ‚’ হাদীস ও ‘আসারে সাহাবা’ বর্ণিত রয়েছে। এগুলো দ্বারা ওই রাতের ফযীলত ও মর্যাদা প্রমাণিত হয়। সালাফে সালেহীনের কেউ কেউ এ রাতে নফল নামাযের ব্যাপারে যতœবান হতেন। আর শাবানের রোযার ব্যাপারে তো সহীহ হাদীসসমূহই রয়েছে।

‘কোনো কোনো আলেম যদিও এই রাতের ফযীলত অস্বীকার করেন; কিন্তু হাম্বলী ও গায়রে হাম্বলী অধিকাংশ আলেমই এই রাতের ফযীলতের কথা স্বীকার করে থাকেন। ইমাম আহমাদ রাহ.-এর মতও তাই। কেননা এর ফযীলত সম্পর্কে একাধিক হাদীস বর্ণিত হয়েছে এবং এগুলোর সমর্থনে সালাফ (সাহাবী ও তাবেয়ী)-এর ‘আসার’ও বিদ্যমান আছে; যেগুলো ‘সুনান’ ও ‘মুসনাদ’ শিরোনামে সংকলিত হাদীসের কিতাবে [বরং কতক ‘সহীহ’ শিরোনামের কিতাবেও যেমন সহীহ ইবনে খুযাইমা (কিতাবুত তাওহীদ), সহীহ ইবনে হিব্বান প্রভৃতিতে] রয়েছে। যদিও এ ব্যাপারে বহু বিষয় জালও করা হয়েছে। ইকতিযাউস সিরাতিল মুস্তাকীম ২/১৩৬, ১৩৭

এ রাতের আমল সম্পর্কে ‘শুআবুল ঈমান’ বায়হাকীর নিম্নোক্ত হাদীসটি লক্ষ করুন।

হযরত আলা ইবনুল হারিছ রাহ. থেকে বর্ণিত, হযরত আয়েশা রা. বলেন

قَامَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ مِنَ اللّيْلِ يُصَلِّي فَأَطَالَ السّجُودَ حَتّى ظَنَنْتُ أَنّهُ قَدْ قُبِضَ، فَلَمّا رَأَيْتُ ذَلِكَ قُمْتُ حَتّى حَرّكْتُ إِبْهَامَهُ فَتَحَرّكَ، فَرَجَعْتُ، فَلَمّا رَفَعَ رَأْسَهُ مِنَ السّجُودِ، وَفَرَغَ مِنْ صَلَاتِهِ، قَالَ: يَا عَائِشَةُ أَوْ يَا حُمَيْرَاءُ ظَنَنْتِ أَنّ النّبِيّ خَاسَ بِكِ؟ ، قُلْتُ: لَا وَاللهِ يَا رَسُولَ اللهِ وَلَكِنِّي ظَنَنْتُ أَنّكَ قُبِضْتَ لِطُولِ سُجُودِكَ، فَقَالَ: أَتَدْرِينَ أَيّ لَيْلَةٍ هَذِهِ؟ ، قُلْتُ: اللهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ، قَالَ: هَذِهِ لَيْلَةُ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ، إِنّ اللهَ عَزّ وَجَلّ يَطْلُعُ عَلَى عِبَادِهِ فِي لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ فَيَغْفِرُ لِلْمُسْتَغْفِرِينَ، وَيَرْحَمُ الْمُسْتَرْحِمِينَ، وَيُؤَخِّرُ أَهْلَ الْحِقْدِ كَمَا هُمْ.

একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে নামাযে দাঁড়ান এবং এত দীর্ঘ সিজদা করেন যে, আমার ধারণা হল, তিনি হয়তো মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি  তখন উঠে তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল। যখন তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামায শেষ করলেন তখন আমাকে লক্ষ করে বললেন, হে আয়েশা, অথবা বলেছেন, ও হুমায়রা! তোমার কি এই আশংকা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসূল তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি উত্তরে বললাম আল্লাহর কসম, না, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার দীর্ঘ সেজদা থেকে আমার আশংকা হয়েছিল, আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কি না। নবীজী জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি জান এটা কোন্ রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন ইরশাদ করলেন এটা হল অর্ধ-শাবানের রাত। (শাবানের চৌদ্দ তারিখের দিবাগত রাত।) আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে তাঁর বান্দার প্রতি মনোযোগ দেন এবং ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহপ্রার্থীদের প্রতি অনুগ্রহ করেন আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই।’ শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ৩৫৫৪

ইমাম বাইহাকী রাহ. এই হাদীসটি বর্ণনা করার পর এর সনদের ব্যাপারে বলেন

هذا مرسل جيد

হাদীস শরীফের বর্ণনা থেকে এ রাতের আমলের ব্যাপারে যতটুকু পাওয়া যায় তা হচ্ছে এ রাতে বিশেষভাবে তওবা-ইস্তিগফার, দুআ-রোনাযারী এবং নফল ইবাদতে মশগুল থাকা। একা একা যার পক্ষে যতটুকু সম্ভব সাধারণ নফল ইবাদতে মনোযোগী হওয়া। যিকির-তাসবীহ পড়া, দুআ-দরূদ পড়া, লম্বা লম্বা রুকূ-সিজদায় নফল পড়া, কুরআন মাজীদ তিলাওয়াত করা ইত্যাদি। এ পরিমাণ ইবাদত করা, যাতে এর দ্বারা ফরয আমলে ব্যাঘাত না ঘটে। এমন যেন না হয়, সারারাত নফলে মশগুল থেকে ফজরের জামাত ছুটে গেল বা কাযা হয়ে গেল।

তেমনি গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা। বিশেষ করে ওইসব গুনাহ এবং নাফরমানি থেকে গুরুত্বের সাথে বেঁচে থাকা যেগুলো এ রাতের সাধারণ ক্ষমা থেকে বঞ্চিত করে দেয়।

এছাড়া নির্ভরযোগ্য সূত্রে এ রাতকে ঘিরে বিশেষ কোনো আমলের ব্যাপারে বিশেষ কোনো বিবরণ পাওয়া যায় না। সম্মিলিত ইবাদত, নির্দিষ্ট সূরা দিয়ে বিশেষ নামায, সম্মিলিত মীলাদ-মাহফিল, শবীনা খতম ইত্যাদি যেসকল রেওয়াজ কোনো কোনো সমাজে প্রচলিত রয়েছে তা গ্রহণযোগ্য নয়।

শাবানের পনের তারিখের রোযা

হযরত আলী ইবনে আবি তালেব রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন

إِذَا كَانَتْ لَيْلَةُ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ، فَقُومُوا لَيْلَهَا وَصُومُوا نَهَارَهَا، فَإِنّ اللهَ يَنْزِلُ فِيهَا لِغُرُوبِ الشّمْسِ إِلَى سَمَاءِ الدّنْيَا، فَيَقُولُ: أَلَا مِنْ مُسْتَغْفِرٍ لِي فَأَغْفِرَ لَهُ أَلَا مُسْتَرْزِقٌ فَأَرْزُقَهُ أَلَا مُبْتَلًى فَأُعَافِيَهُ أَلَا كَذَا أَلَا كَذَا، حَتّى يَطْلُعَ الْفَجْرُ.

পনের শাবানের রাত (চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত) যখন আসে তখন তোমরা এ রাতটি ইবাদত-বন্দেগীতে কাটাও এবং দিনের বেলা রোযা রাখ। কেননা, এ রাতে সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তাআলা প্রথম আসমানে আসেন এবং বলেন, আছে কি কোনো ক্ষমাপ্রার্থী? আমি তাকে ক্ষমা করব। আছে কি কোনো রিযিকপ্রার্থী? আমি তাকে রিযিক দেব। এভাবে সুব্হে সাদিক পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা মানুষের প্রয়োজনের কথা বলে তাদের ডাকতে থাকেন। সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৩৮৮

ইমাম ইবনে রজব হাম্বলী রাহ. বলেন, শাবানের পনের তারিখে রোযা রাখা নিষিদ্ধ নয়। কেননা এই পনের তারিখ তো আইয়ামে বীযেরই (প্রত্যেক আরবী মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ) একটি দিন, হাদীস শরীফে যে দিনগুলোতে রোযা রাখার কথা এসেছে। এছাড়া এ দিনে রোযা রাখার ব্যাপারে সুনানে ইবনে মাজাহ্য় হযরত আলী ইবনে আবী তালেব রা. থেকে বর্ণিত স্বতন্ত্র হাদীসও বর্ণিত হয়েছে। যদিও তার সনদ দুর্বল। লাতায়েফুল মাআরেফ, পৃ. ১৯৭

তো একদিকে নবীজী শাবান মাসে রোযা রাখার বিশেষ এহতেমাম করতেন, পাশাপাশি শাবানের পনের তারিখ আইয়ামে বীযেরও একটি দিন, অতএব কেউ যদি এই বিবেচনায় শাবানের পনের তারিখে রোযা রাখে তাহলে ইনশাআল্লাহ মাহরূম হবে না। তবে সম্ভব হলে আইয়ামে বীযের তিন দিনই (চাঁদের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ) নফল রোযা রাখতে পারলে সবচে উত্তম হয়।

শবে বরাত : ভারসাম্য রক্ষা করি

শবে বরাতকে ঘিরে আমাদের সমাজে রয়েছে দ্বিমুখী প্রান্তিকতা। কেউ কেউ শবে বরাতের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করতে চান, যা একদমই অনুচিত। তাদের জন্য আশা করি উপরোক্ত হাদীসের বিবরণ যথার্থ হবে। আর কোথাও কোথাও এ রাতকে ঘিরে রয়েছে নানা ধরনের রসম-রেওয়াজ এবং বিভিন্ন গর্হিত কর্মকাÐ, যা সম্পূর্ণ পরিত্যাজ্য।

শবে বরাত উপলক্ষে খিচুরি হালুয়ার রসম, পটকা-আতসবাজির সংস্কৃতি, দোকান-পাট, ঘর বাড়ি, এমনকি মসজিদ আলোকসজ্জা করা, বিভিন্ন মেলার আয়োজন করা, কবরস্তান ও মাজারে মাজারে ভিড় জমানোর রেওয়াজ, কিশোর-যুবকদের দলবেঁধে ঘুরাঘুরি করার প্রবণতা, মাজারে এবং মেলায় নারীদের ভিড় জমানো ইত্যাদি যে প্রচলন রয়েছে তা অত্যন্ত আপত্তিকর। এগুলোর কিছু কিছু তো সম্পূর্ণ হারাম এবং নাজায়েয। আর কিছু কিছু রয়েছে, যা সাধারণ অবস্থায় বৈধ হলেও (যেমন হালুয়া রুটি খাওয়া এবং খাওয়ানো) শবে বরাতের আমল মনে করা বিদআত। অতএব এসবে সময় নষ্ট না করে বিশেষ সময়ের বিশেষ কদর করা চাই। দীর্ঘ দীর্ঘ আমল করা সম্ভব না হলে অন্তত এশা ও ফজর জামাতে পড়ার চেষ্টা করি। এবং যতটুকু পারি নফল আমল করি। শয়তানের ধোঁকায় পড়ে অহেতুক বিতর্কে জড়িয়ে কিংবা নানা রসম রেওয়াজে লিপ্ত হয়ে নিজের দ্বীনী ঈমানী ক্ষতি করা মোটেও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় নয়।

[এ সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানতে দেখুন, উস্তাযে মুহতারাম হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক ছাহেব দামাত বারাকাতুহুমের প্রবন্ধমালা ‘বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শাবান ও শবে বরাত’ (মাসিক আলকাউসার, সেপ্টেম্বর ২০০৫ ঈ.); ‘শবে বরাত : কিছু ভ্রান্তি নিরসন’ (মাসিক আলকাউসার, আগস্ট ২০০৮ ঈ.); ‘উলামায়ে সালাফের উক্তির আলোকে শবে বরাত’ (মাসিক আলকাউসার, সেপ্টেম্বর ২০০৬ ঈ.) এবং নির্বাচিত প্রবন্ধ, খ. ২, পৃ. ১০৩-১২০। আরো দেখুন, ‘অজ্ঞতা ও রসম-রেওয়াজের কবলে শাবান-শবে বরাত : নববী নির্দেশনাই মুক্তির উপায়’ মাসিক আলকাউসার, আগস্ট ২০০৭ ঈ.)]

মাহে রমযান : নেক আমলের বসন্ত

শাবানের পরই আগমন করে মুমিনের বহু কাক্সিক্ষত ও প্রত্যাশিত রমযানুল মুবারক। কুরআন নাযিলের মাস। খায়ের ও বরকতের মাস। তাকওয়া অর্জনের মাস। আমলে অগ্রগামী হওয়ার মাস। নেকী হাছিলের মাস। গুনাহ তরক করার মাস। ক্ষমা লাভের মাস। প্রবৃত্তির লাগাম টেনে ধরার মাস। সংযম সাধনার মাস। ভ্রাতৃত্ব চর্চার মাস। সদয় ও সহানুভূতির মাস। দেহমন শুদ্ধ ও পবিত্র করার মাস।

মুমিন জীবনের বসন্ত রমযানুল মুবারক। রমযানের চাঁদ উঠতেই ঘোষণা হতে থাকে

يَا بَاغِيَ الخَيْرِ أَقْبِلْ، وَيَا بَاغِيَ الشّرِّ أَقْصِرْ.

ওহে কল্যাণ অন্বেষী, তুমি সুসংবাদ গ্রহণ কর, নেকীর পথে তুমি আরো বেগবান হও। ওহে অকল্যাণের পথিক, তুমি  নিবৃত্ত হও, নিয়ন্ত্রিত হও। জামে তিরমিযী, হাদীস ৬৮২; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৬৪২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৮৭৯৫, ২৩৪৯১

অতএব এ মাস আখেরাতের পাথেয় গোছানোর মাস, সারা বছরের ঈমানী আমলী এবং তাকওয়ার পাথেয় সঞ্চয়ের মাস। সর্বোপরি এ মাস হল প্রস্তুতি গ্রহণের মাস, মুত্তাকী হওয়ার মাস।

এ মাসে আল্লাহ তাআলা ঈমানদারদের জন্য রোযা ফরয করেছেন, যা ইসলামের মৌলিক একটি স্তম্ভ। ঈমান ও ইহতিসাবের (সওয়াবপ্রাপ্তির আশায়) সাথে সিয়াম সাধনা বান্দার গুনাহ মাফ করে দেয়।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন

مَنْ صَامَ رَمَضَانَ، إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا، غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدّمَ مِنْ ذَنْبِهِ.

যে ব্যক্তি ঈমান এবং ইহতিসাব তথা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস এবং সওয়াবের প্রত্যাশা রেখে রমযান মাসে রোযা রাখবে, তার পূর্বের গুনাহগুলো মাফ করে দেওয়া হবে। সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৮

রমযানের প্রতিটি ইবাদত, প্রতিটি মুহূর্ত বিশেষ মর্যাদা ধারণ করে। এর কিয়াম-তারাবীহ, সাহরী-ইফতার, তাসবীহ-তাহলীল, তিলাওয়াত-মুনাজাত সবকিছুর রয়েছে বিশেষ ফযীলত। এর প্রতিটি আমল বান্দাকে তাকওয়ার সোপানে উন্নীত করে এবং আল্লাহর নৈকট্য ত্বরান্বিত করে।

নবীজী বলেন

مَنْ قَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا، غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدّمَ مِنْ ذَنْبِهِ.

 যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতিসাব তথা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও সওয়াবের প্রত্যাশা রেখে কিয়ামে রমযান (প্রথমত তারাবীহ এবং দ্বিতীয়ত তাহাজ্জুদসহ অন্যান্য নওয়াফেল আদায়) করবে তার বিগত গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। সহীহ বুখারী, হাদীস ২০০৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৭৫৯

অতএব রোযার সাথেসাথে তারাবীহর প্রতি যতœবান হই। তাহাজ্জুদের অভ্যাস করি। সাহরীর প্রতি গুরুত্ব দিই। খেয়াল রাখি, আমার রোযা যেন আমার জন্য ঢাল হয়। আমার কোনো ত্রæটির কারণে যেন এ ঢাল বিদীর্ণ না হয়। ঈমানী লজ্জত ও স্বাদ উপভোগ করি ইফতারের মুবারক মুহূর্তে। যিকির-তিলাওয়াতে সতেজ রাখি আমার যবান। গুনাহের পঙ্কিলতা ঝেড়ে ফেলে সজীব করে তুলি হৃদয়-ভ‚মিকে। শুরু করি ঈমানী-আমলী জীবনের নতুন পথচলা।

হাজার রজনী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ লাইলাতুল কদর। লাইলাতুল কদরের অন্বেষায় বিভোর থাকি গোটা রমযান। বিশেষ করে শেষ দশক, যে দশকে নবীজী কোমর বেঁধে ইবাদতে মগ্ন হতেন। মনে রাখি নবীজীর সেই কথা

إِنّ هَذَا الشّهْرَ قَدْ حَضَرَكُمْ، وَفِيهِ لَيْلَةٌ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ، مَنْ حُرِمَهَا فَقَدْ حُرِمَ الْخَيْرَ كُلّهُ، وَلَا يُحْرَمُ خَيْرَهَا إِلّا مَحْرُومٌ.

এই মহিমান্বিত মাস উপস্থিত। তাতে একটি রজনী রয়েছে, যা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। যে ব্যক্তি এর কল্যাণ ও বরকত থেকে বঞ্চিত থাকল সে যেন সকল কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত হল। আর কেবল অভাগাই এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত থাকে। সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৬৪৪; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ২১০৬; সুনানে কুবরা, নাসায়ী, হাদীস ২৪২৭

আরো মনোযোগী হই ইতিকাফের প্রতি। যা ছিল নবীজীর দায়েমী আমল। শেষ দশকে। তা সম্ভব না হলে অন্তত বেজোড় রাতগুলোয় কিংবা যার পক্ষে যতটুকু সম্ভব।

রমযান ভ্রাতৃত্ব ও সহমর্মিতার মাস। মুমিনগণ সহযোগিতার হাত প্রসারিত করি। খোঁজ-খবর নিই আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী এবং আমার অভাবী ভাইবোনের। নেক ও কল্যাণে আরো ধাবিত হই। যাদের উপর ওয়াজিব হবে সদাকাতুল ফিতর তারা তা পৌঁছে দিই গরীবের দুয়ারে সসম্মানে।

সর্বোপরি রমযান যেন অধিক ফলপ্রসূ হয় এজন্য আমাকে আগ থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। এর প্রতিটি মুহূর্ত অত্যন্ত মূল্যবান। এ সময়গুলো যাতে যথাযথ কাজে লাগে এজন্য গুরুত্বের সাথে ফিকির করতে হবে।

এ দিনগুলো দুআ-দরূদ, যিকির-তিলাওয়াত, তওবা-ইস্তিগফার, নফল নামায ইত্যাদি ইবাদতের মাধ্যমে অতিবাহিত করি। গল্পগুজব পরিহার করি। ডিভাইসের অনর্থক ব্যবহার বন্ধ রাখি।

বুযুর্গানে দ্বীন বলে থাকেন, রোযা রেখে ক্লান্ত হয়ে গেলে প্রয়োজনে বিশ্রাম করুন। কিন্তু অনর্থক গল্পগুজবে লিপ্ত হবেন না। কারণ কথায় কথা টানতে থাকে এবং আল্লাহ না করুন, বেশি কথা বললে তা ধীরে ধীরে মিথ্যা, গীবত-শেকায়েতের  দিকে চলে যায়। অতএব দুনিয়াবী কাজকর্ম সীমিত করে আনুন। ইবাদতের প্রতি বেশি মনোযোগ দিন।

রমযানে গুনাহর ধারা অব্যাহত রাখা খুবই খারাপ কথা। যেখানে ঘোষণা হতে থাকে নেকীর কাজে অগ্রসর হতে, অনিষ্ট থেকে নিবৃত্ত হতে, সেখানে গুনাহের ধারা অব্যাহত রাখা অনেক বড় মাহরূমির কারণ। বিশেষ করে অনাচার-পাপাচার ও অশ্লীলতা এবং এমন গুনাহ, যা আল্লাহর ক্রোধকে আরো বাড়িয়ে দেয়, এমন সব বিষয় পুরোপুরি বর্জন করা উচিত; এবং এখন থেকে সারা জীবনের জন্য বর্জন করা উচিত। কারণ ফিরে আসার এটাই মোক্ষম সময়। কিন্তু ফিরে না এসে এর অনুভ‚তিও জাগ্রত না হওয়া বহুত বড় বরবাদির বিষয়।

রমযান উপলক্ষে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, পণ্য মজুতকরণ, খাদ্যে ভেজাল ইত্যাদি অসাধুতা অত্যন্ত গর্হিত মানসিকতার পরিচায়ক। সহমর্মিতার মাসে এ ধরনের অন্যায় সত্যিই বড় জুলুম। সংশ্লিষ্ট বন্ধুরা বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করবেন।

আর ঈদকে সামনে রেখে যে শপিং-সংস্কৃতি সমাজে চালু হয়েছে এবং তাতে ব্যাপকহারে নারীদের অংশগ্রহণ ও বেপর্দা প্রকাশ পাচ্ছে তা খুবই উদ্বেগের কথা। দেখা যায়, রমযানের শেষ দিকে এর চাপ আরো প্রবল হয়। আফসোসের কথা হল, যেখানে শেষ দশকে লাইলাতুল কদর তালাশ করতে বলা হয়েছে এবং নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোমর বেঁধে ইবাদতে মশগুল হতেন, পরিবারের লোকদের সজাগ করতেন তখন আমি কেনাকাটায় ব্যস্ত! তাই ঈদের প্রয়োজন আগ থেকেই সেরে নিই, নারীদের যেন মার্কেটে যেতে না হয় এজন্য পুরুষরা সহায়তা করি এবং শেষ দশকে আমলে লিপ্ত হই, শবে কদর তালাশে উন্মুখ থাকি।

এক্ষেত্রে নবীজীর এই হাদীস স্মরণ রাখি; হযরত জাবের রা. থেকে বর্ণিত

أَنّ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ رَقَى الْمِنْبَرَ، فَلَمّا رَقَى الدّرَجَةَ الْأُولَى قَالَ: آمِينَ ، ثُمّ رَقَى الثّانِيَةَ فَقَالَ: آمِينَ، ثُمّ رَقَى الثّالِثَةَ فَقَالَ: آمِينَ، فَقَالُوا: يَا رَسُولَ اللهِ، سَمِعْنَاكَ تَقُولُ: آمِينَ ثَلَاثَ مَرّاتٍ؟ قَالَ: لَمّا رَقِيتُ الدّرَجَةَ الْأُولَى جَاءَنِي جِبْرِيلُ فَقَالَ: شَقِيَ عَبْدٌ أَدْرَكَ رَمَضَانَ، فَانْسَلَخَ مِنْهُ وَلَمْ يُغْفَرْ لَهُ، فَقُلْتُ: آمِينَ. ثُمّ قَالَ: شَقِيَ عَبْدٌ أَدْرَكَ وَالِدَيْهِ أَوْ أَحَدَهُمَا فَلَمْ يُدْخِلَاهُ الْجَنّةَ، فَقُلْتُ: آمِينَ. ثُمّ قَالَ: شَقِيَ عَبْدٌ ذُكِرْتَ عِنْدَهُ وَلَمْ يُصَلِّ عَلَيْكَ، فَقُلْتُ: آمِينَ.

নবীজী একবার মিম্বারে আরোহণ করলেন। প্রথম ধাপে উঠে বললেন, আমীন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে উঠেও বললেন, আমীন। সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন (কী বিষয় আল্লাহর রাসূল!) আপনাকে (এভাবে) আমীন বলতে শুনলাম। তখন নবীজী বললেন, আমি যখন মিম্বারে আরোহণ করলাম তখন জিবরীল আগমন করলেন এবং বললেন, ঐ ব্যক্তি হতভাগা, যে রমযান মাস পেল, আর রমযান গত হয়ে গেল কিন্তু তার গোনাহ মাফ হলো না। আমি বললাম, আমীন। তারপর বললেন, ঐ ব্যক্তি হতভাগা, যে তার মা-বাবাকে অথবা কোনো একজনকে পেল অথচ তারা (মা-বাবা) তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাল না (অর্থাৎ তাদের খেদমতের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সন্তান জান্নাতে প্রবেশ করতে পারল না।) আমি বললাম, আমীন। তৃতীয় বার বললেন, ঐ ব্যক্তি হতভাগা, যার সামনে আপনার নাম উচ্চারিত হল আর সে আপনার উপর দরূদ পাঠ করল না। বললাম, আমীন। আলআদাবুল মুফরাদ, বুখারী, হাদীস ৬৪৪; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৭৪৫১

রমযান কীভাবে যাপন করতে হয় এজন্য আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের রমযানী যিন্দেগী থেকেও অনেক খোরাক লাভ করা যায়। এক্ষেত্রে শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা যাকারিয়া রাহ.-এর ‘আকাবির কা রমযান’ (এর বাংলা তরজমাও পাওয়া যায়) পড়লেও ফায়দা হবে ইনশাআল্লাহ। দেখবেন, আমাদের বুযুর্গানে দ্বীন রমযান মাসকে কত সাদরে বরণ করতেন! কত গুরুত্বের সাথে এর প্রতিটি মুহূর্তের কদর করতেন!

মোটকথা, রমযান আসে, রমযান যায়। এভাবে জীবনও একদিন শেষ হয়ে যাবে। বুদ্ধিমান তো সে, যে আগ থেকেই প্রস্তুতি নিতে থাকে। রমযান আসার আগেই মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করে, আমলের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। রমযানকে সামনে রেখে সে প্রস্তুত করে জীবনের নতুন রুটিন। কাজে লাগায় রমযানের বরকতময় প্রতিটি মুহূর্ত। সে অগ্রগামী হয় নেক ও কল্যাণের পথে, তাকওয়া হাছিলের পথে এবং ব্রত হয় গুনাহ থেকে পাক-ছাফ হয়ে আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জন করার মেহনতে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সেই তাওফীক দান করুন। রমযানের সমূহ কল্যাণ ও ফযীলত লাভ করে মাগফিরাত ও রহমতে স্নাত হওয়ার তাওফীক নসীব করুন আমীন।

ঈদুল ফিত্র : মুমিনের পুরস্কার লাভ ও ক্ষমাপ্রাপ্তির দিন

রমযানুল মুবারকের পুরো এক মাস সিয়াম সাধনার পর আজ পয়লা শাওয়াল। আজ ঈদের দিন। আনন্দ-উৎসবের দিন। এ আনন্দ আল্লাহর নিআমত প্রাপ্তির। মাগফিরাত প্রত্যাশার। আল্লাহর প্রতি সমর্পিত হওয়ার। আল্লাহ তোমার হুকুম আদায় করার তাওফীক দিয়েছ, তোমার শোকর হে আল্লাহ! তুমি মাগফিরাতের ঘোষণা দিয়েছ, সে প্রত্যাশা রাখি হে আল্লাহ!

নিআমতের শুকরিয়া আদায়ের দিন আজকের ঈদ। আজকের আনন্দ প্রকাশ পাবে আল্লাহর বড়ত্ব বর্ণনা করে, তাকবীরের মাধ্যমে। আল্লাহ তাআলা (এদিকে ইঙ্গিত করে) বলেন

وَ لِتُكْمِلُوا الْعِدَّةَ وَ لِتُكَبِّرُوا اللهَ عَلٰی مَا هَدٰىكُمْ وَ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ.

এবং (তিনি চান) যাতে তোমরা (রোযার) সংখ্যা পূরণ করে নাও এবং আল্লাহ তোমাদেরকে যে পথ দেখিয়েছেন সেজন্য আল্লাহর তাকবীর পাঠ কর এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। সূরা বাকারা (২) : ১৮৫

প্রত্যেক জাতিরই আনন্দ-পর্ব রয়েছে। আমাদের নবীজীও দিয়েছেন আমাদের আনন্দের দিন। এই ঈদের দিনই সেই দিন। নবীজী বলেন

إِنّ لِكُلِّ قَوْمٍ عِيدًا وَهَذَا عِيدُنَا.

প্রত্যেক জাতিরই নিজস্ব উৎসবের দিন রয়েছে; আর এই দিন হল আমাদের উৎসবের দিন। সহীহ বুখারী, হাদীস ৯৫২, ৩৯৩১; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৮৯২

অতএব আমাদের ঈদ অন্যদের উৎসবের মতো নয়। এই ঈদ আল্লাহর দেওয়া তোহফা, তাই এর উদ্যাপনও হবে তাঁর সন্তুষ্টি মোতাবেক, শরীয়তের হুকুম অনুসারে।

মুমিনের ঈদ উদ্যাপন

একজন মুমিনের ঈদ উদ্যাপনে কিছু বিষয় লক্ষণীয়। সংক্ষেপে

ক. সদাকাতুল ফিত্র আদায় করা

রোযার মাধ্যমে রোযাদার কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে পেরেছে সারাবছর অনাহারে থাকা অন্ন-বস্ত্রহীন ভাইদের কষ্ট। আজ রমযান শেষে ঈদের দিন সেই ভাইদের মুখেও যেন ফুটে ওঠে আনন্দের রেখা। সাথে সাথে নিজেও যেন পুত-পবিত্র হতে পারে রোযা রাখতে গিয়ে যে ত্রæটি-বিচ্যুতি হয়েছে সেগুলো থেকে। সেজন্য বিত্তবানদের উপর ওয়াজিব করা হয়েছে সদাকাতুল ফিত্র। হযরত ইবনে আব্বাস রা. বলেন

فَرَضَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ زَكَاةَ الْفِطْرِ طُهْرَةً لِلصّائِمِ مِنَ اللّغْوِ وَالرّفَثِ، وَطُعْمَةً لِلْمَسَاكِينِ، مَنْ أَدّاهَا قَبْلَ الصّلَاةِ، فَهِيَ زَكَاةٌ مَقْبُولَةٌ، وَمَنْ أَدّاهَا بَعْدَ الصّلَاةِ، فَهِيَ صَدَقَةٌ مِنَ الصّدَقَاتِ.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদাকাতুল ফিত্র ওয়াজিব করেছেন রোযাদারকে অর্থহীন ও অশ্লীল কথা কাজ থেকে পবিত্র করার জন্য এবং মিসকীনদের খাবারের ব্যবস্থা হিসাবে। যে (ঈদের) নামাযের পূর্বে তা আদায় করবে তা গ্রহণযোগ্য হবে। আর যে নামাযের পর আদায় করবে তা সাধারণ সদাকা হিসাবে বিবেচিত হবে। সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৬০৯

তাই ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বেই সদাকাতুল ফিত্র আদায় করা মুস্তাহাব।

খ. ঈদের দিন : এদিন পানাহারের দিন

পুরো মাস রোযা রাখার পর আজ বান্দার আনন্দের দিন। তাই আল্লাহ তাআলা হারাম করে দিয়েছেন এ দিনের রোযা।

হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন

أَنّ رَسُولَ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ نَهَى عَنْ صِيَامِ يَوْمَيْنِ، يَوْمِ الْفِطْرِ، وَيَوْمِ النّحْرِ.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুই দিন রোযা রাখতে নিষেধ করেছেন। ইয়াওমুল ফিত্র তথা ঈদুল ফিতরের দিন এবং ইয়াওমুন নহর তথা কুরবানীর ঈদের দিন। সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৩৮

গ. ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে খেজুর বা মিষ্টিমুখ করা

যেহেতু ঈদের দিন রোযা রাখা নিষেধ তাই এর প্রকাশ হিসাবে মুস্তাহাব হল ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে কয়েকটি খেজুর খেয়ে যাওয়া এবং এক্ষেত্রে বেজোড় সংখ্যার প্রতি লক্ষ রাখা। খেজুরের ব্যবস্থা না থাকলে অন্য কোনো মিষ্টান্ন গ্রহণ করা। হযরত আনাস রা. বলেন

كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ

لاَ يَغْدُو يَوْمَ الفِطْرِ حَتّى يَأْكُلَ تَمَرَاتٍ. وَقَالَ مُرَجّأُ بْنُ رَجَاءٍ، حَدّثَنِي عُبَيْدُ اللهِ، قَالَ: حَدّثَنِي أَنَسٌ، عَنِ النّبِيِّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ، وَيَأْكُلُهُنّ وِتْرًا.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল ফিতরে খেজুর না খেয়ে বের হতেন না।

তিনি বেজোড় সংখ্যক খেজুর খেতেন। সহীহ বুখারী, হাদীস ৯৫৩

এটা হল ঈদুল ফিতরের ক্ষেত্রে। আর ঈদুল আযহার ক্ষেত্রে মুস্তাহাব হল না খেয়ে ঈদগাহে যাওয়া এবং কুরবানীর গোশত দিয়ে সর্বপ্রথম আহার গ্রহণ করা।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল ফিতরে কিছু খেয়ে বের হতেন আর ঈদুল আযহায় নামায পড়ে খেতেন। জামে তিরমিযী, হাদীস ৫৪২

আরেক বর্ণনায় এসেছে

لَا يَغْدُو يَوْمَ الْفِطْرِ حَتّى يَأْكُلَ، وَلَا يَأْكُلُ يَوْمَ الْأَضْحَى حَتّى يَرْجِعَ فَيَأْكُلَ مِنْ أُضْحِيّتِهِ.

নবীজী ঈদুল ফিতরে না খেয়ে বের হতেন না আর ঈদুল আযহার দিন ঈদগাহ হতে ফেরার পূর্বে কিছু খেতেন না। ঈদগাহ থেকে ফিরে পশু জবাই করার পর নিজ কুরবানীর পশুর গোশত থেকে খেতেন। মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২২৯৮৪; সুনানে দারাকুতনী, হাদীস ১৭১৫; সুনানে সুগরা, বাইহাকী, হাদীস ৬৮৯

ঘ. গোসল করে ঈদগাহে যাওয়া

ঈদের দিন গোসল করে ঈদগাহে যাওয়া মুস্তাহাব। সাহাবায়ে কেরাম গোসল করে ঈদগাহে গমন করতেন। হযরত নাফে রাহ. বলেন

أَنّ عَبْدَ اللهِ بْنَ عُمَرَ كَانَ يَغْتَسِلُ يَوْمَ الْفِطْرِ قَبْلَ أَنْ يَغْدُوَ إِلَى الْمُصَلّى.

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. ঈদুল ফিতরে ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে গোসল করে নিতেন। মুয়াত্তা মালেক, হাদীস ৪৮৮

ঙ. উত্তম পোশাক পরিধান করা

সামর্থ্য মোতাবেক ঈদের দিন উত্তম পোশাক পরিধান করা এবং বৈধ সাজগোজ গ্রহণ করা মুস্তাহাব। সাহাবায়ে কেরাম এমনটি করতেন। নাফে রাহ. বলেন

أَنّ ابْنَ عُمَرَ كَانَ يَلْبَسُ فِي الْعِيدَيْنِ أَحْسَنَ ثِيَابِهِ .

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. দুই ঈদে উত্তম পোশাক পরতেন। সুনানে কুবরা, বাইহাকী, হাদীস ৬১৪৩; ফাতহুল বারী ৬/৬৮, ৮/৪১৪

হযরত জাবের রা. বলেন

كَانَتْ لِلنّبِيِّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ جُبّةٌ يَلْبَسُهَا فِي الْعِيدَيْنِ، وَيَوْمِ الْجُمُعَةِ.

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের (উন্নত) একটি জুব্বা ছিল যা তিনি দুই ঈদে এবং জুমআর দিন পরতেন। সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস ১৭৬৬

ইবনুল কায়্যিম রাহ. বলেন, নবীজীর একটি উত্তম পোশাক ছিল, তিনি দুই ঈদে এবং জুমায় তা পরিধান করতেন। যাদুল মাআদ ১/৪২৫

অতএব ঈদের দিন সাধ্যানুযায়ী উত্তম পোশাক পরা মুস্তাহাব। তবে উত্তম পোশাক অর্থ নতুন পোশাক নয়। তাই ঈদের জন্য নতুন পোশাক কেনার বাহানায় রমযানের মূল্যবান সময় নষ্ট করা মোটেও সমীচীন নয়।

চ. ঈদের দিন তাকবীর বলা

ঈদের দিনের একটি বিশেষ আমল হল বেশি বেশি তাকবীর বলা। তাকবীর হল

اللهُ أَكْبَرُ اللهُ أَكْبَرُ، لَا إِلَهَ إِلّا اللهُ، وَاللهُ أَكْبَرُ اللهُ أَكْبَرُ وَلِلهِ الْحَمْدُ

ঈদগাহে যাওয়ার সময় বিশেষ গুরুত্বের সাথে তাকবীর বলবে। নাফে রাহ. বলেন

أَنّهُ كَانَ إِذَا غَدَا يَوْمَ الْأَضْحَى وَيَوْمَ الْفِطْرِ يَجْهَرُ بِالتّكْبِيرِ حَتّى يَأْتِيَ الْمُصَلّى ثُمّ يُكَبِّرُ حَتّى يَأْتِيَ الْإِمَامُ.

ইবনে উমর রা. ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতরের সকালে সশব্দে তাকবীর বলতে বলতে ঈদগাহে যেতেন এবং ইমাম আসা পর্যন্ত তাকবীর বলতে থাকতেন। সুনানে দারাকুতনী, হাদীস ১৭১৬; সুনানে কুবরা, বাইহাকী, হাদীস ৬১২৯

ছ. এক পথে যাওয়া আরেক পথে ফেরা

সম্ভব হলে ঈদগাহে যাওয়ার সময় এক পথে যাওয়া আর ফেরার সময় ভিন্ন পথে আসা। নবীজী এমনটি করতেন। হযরত জাবের রা. বলেন

كَانَ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ إِذَا كَانَ يَوْمُ عِيدٍ خَالَفَ الطّرِيقَ.

নবীজী ঈদের দিন এক পথ দিয়ে ঈদগাহে যেতেন আর ভিন্ন পথ দিয়ে ফিরতেন। সহীহ বুখারী, হাদীস ৯৮৬

জ. পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া

যতটুকু সম্ভব পাঁয়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া মুস্তাহাব। হযরত ইবনে উমর রা. বলেন

كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ يَخْرُجُ إِلَى الْعِيدِ مَاشِيًا، وَيَرْجِعُ مَاشِيًا.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যেতেন এবং পায়ে হেঁটে ফিরতেন। সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১২৯৫, ১২৯৪

ঝ. একে-অপরের জন্য দুআ করা

ঈদের দিন সাহাবায়ে কেরাম দুআসুলভ বাক্যে সৌজন্য বিনিময় করতেন। হাফেয ইবনে হাজার রাহ. উল্লেখ করেন, তাবেয়ী জুবাইর ইবনে নুফাইর বলেন

كَانَ أَصْحَابُ رَسُولِ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ إِذَا الْتَقَوْا يَوْمَ الْعِيدِ يَقُولُ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ تَقَبّلَ اللهُ مِنّا وَمِنْكَ.

 রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণ ঈদের দিন পরস্পর সাক্ষাতে বলতেন

تَقَبّلَ اللهُ مِنّا وَمِنْكَ.

(আল্লাহ আমাদের আমলগুলো কবুল করুন এবং তোমারও।) ফাতহুল বারী ২/৪৪৬

এরকম সৌজন্য বিনিময়ের মাধ্যমে উত্তম আচরণ প্রকাশিত হয় এবং মুসলিম ভ্রাতৃত্ব সুদৃঢ় হয়।

ঞ. ঈদের নামাযের কেরাত

ঈদের নামাযের জন্য বিশেষ কোনো সূরা নির্ধারিত নেই। তবে হাদীসে পাওয়া যায় নবীজী কোন্ কোন্ সূরা দিয়ে ঈদের নামায পড়িয়েছেন। হযরত আবু ওয়াকিদ লাইসী রা. বলেন, উমর ইবনে খাত্তাব রা. আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, নবীজী ঈদের নামাযে কী কেরাত পড়তেন? আমি বললাম

بِـ اقْتَرَبَتِ السّاعَةُ، وَق وَالْقُرْآنِ الْمَجِيدِ

সূরা ক্বামার ও সূরা ক্বফ। সহীহ মুসলিম, হাদীস ৮৯১

এছাড়া হযরত নুমান ইবনে বাশীর রা. বলেন

كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ يَقْرَأُ فِي الْعِيدَيْنِ، وَفِي الْجُمُعَةِ بِـ سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْأَعْلَى، وَ هَلْ أَتَاكَ حَدِيثُ الْغَاشِيَةِ، قَالَ: وَإِذَا اجْتَمَعَ الْعِيدُ وَالْجُمُعَةُ، فِي يَوْمٍ وَاحِدٍ، يَقْرَأُ بِهِمَا أَيْضًا فِي الصّلَاتَيْنِ.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুই ঈদের নামাযে এবং জুমার নামাযে সূরা আ‘লা ও সূরা গাশিয়া পড়তেন। আর জুমা ও ঈদ একই দিনে হলে তখনও তিনি উভয় নামাযে এই সূরাই পড়তেন। সহীহ মুসলিম, হাদীস ৮৭৮

ঈদের প্রেক্ষাপট ও তাৎপর্য

ঈদ মুসলিম মিল্লাতের শিআর এবং ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি পরিচয়-চিহ্ন। আমাদের ঈদ আমাদেরই। শরীয়তের অন্যান্য বিধানের মতো আমাদের ঈদেরও রয়েছে অর্থ-মর্ম এবং স্বাতন্ত্র্য। বিজাতীয় কোনো উৎসব-উদ্যাপনের সাথে আমাদের ঈদের কোনো সম্পর্ক নেই। ঈদ নিছক কোনো বিনোদন বা পর্ব-উৎসব নয়; বরং ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল। ঈদের প্রেক্ষাপট যদি লক্ষ্য করি তাহলে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে। হযরত আনাস রা. বলেন

قَدِمَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ الْمَدِينَةَ وَلَهُمْ يَوْمَانِ يَلْعَبُونَ فِيهِمَا، فَقَالَ: مَا هَذَانِ الْيَوْمَانِ؟ قَالُوا: كُنّا نَلْعَبُ فِيهِمَا فِي الْجَاهِلِيّةِ، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ: إِنّ اللهَ قَدْ أَبْدَلَكُمْ بِهِمَا خَيْرًا مِنْهُمَا: يَوْمَ الْأَضْحَى، وَيَوْمَ الْفِطْرِ.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদীনায় আগমন করলেন দেখলেন, মদীনার অধিবাসীরা বছরে দুই বার খেলাধুলা ইত্যাদির মাধ্যমে আনন্দ-উৎসব করে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, এ দুই দিন কীসের দিন? লোকেরা উত্তরে বলল, আমরা জাহেলী যুগ থেকে এ দুই দিন আনন্দ-উৎসব করে আসছি। তখন নবীজী বললেন, এ দুটি দিনের পরিবর্তে আল্লাহ তোমাদেরকে উত্তম দুটি দিন দান করেছেন। সে দুটি দিন হল, ইয়াওমুল আযহা ও ইয়াওমুল ফিত্র (অর্থাৎ ঈদুল ফিত্র ও ঈদুল আযহা)। সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১১৩৪

অর্থাৎ বিজাতীয় পর্ব-উৎসব আমাদের নয়; আমাদের ঈদ আল্লাহ প্রদত্ত। আর তা হচ্ছে দুই ঈদের দিন। ইসলামে তৃতীয় কোনো ঈদ-উৎসব নেই।

অতএব আমাদের ঈদের আনন্দ হবে নির্মল, পাপ-পঙ্কিলতামুক্ত। বিজাতীয় উৎসব-উদ্যাপন থেকে ভিন্ন। আনন্দ উদ্যাপিত হবে শরীয়তের সীমার মাঝে থেকে। আমাদের ঈদ উদ্যাপনের মূল কর্মসূচী তো শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত। নবীজীর সুন্নাহ্য় স্পষ্টরূপে বিবৃত। যার কিছু বিষয় আমরা উপরে আলোচনা করেছি। এর পাশাপাশি শরীয়তের সীমার ভেতর থেকে সামাজিকতা রক্ষা এবং আনন্দ-বিনোদনেও নিষেধাজ্ঞা নেই।

তবে ঈদের মূলপাঠ হচ্ছে, আল্লাহ তাআলার নিআমত প্রাপ্তির অনুভ‚তি এবং ক্ষমাপ্রাপ্তির প্রত্যাশা অন্তরে জাগরূক রেখে ঈদগাহে হাজির হওয়া। রোনাযারির মাধ্যমে আল্লাহর দরবারে সমর্পিত হওয়া। এরপর অন্যান্য বৈধ সামাজিকতার পর্ব।

আমাদের সালাফের হালত তো এমন ছিল যে, তারা ঈদের দিন তটস্থ থাকতেন। তাদের বক্তব্য ছিল আমি গোলাম। আমার মনিব আমাকে কাজ করার (আমলের) হুকুম করেছেন। আমি করেছি বটে। কিন্তু তিনি কতটুকু পছন্দ করেছেন তা আমার জানা নেই। গোটা রমযান জুড়ে রহমত ও মাগফিরাতের বহু উপলক্ষ বিরাজ করছিল। আমি এ নিআমতের কতটুকু সদ্ব্যবহার করতে পারলাম ঈদের দিন আনন্দের পাশাপাশি এ অনুভ‚তিও তাদের ভাবিয়ে তুলত। (দ্রষ্টব্য : লাতায়েফুল মাআরেফ, পৃ. ২৯৬, ২৯৭)

অতএব এমন যেন না হয় যে, আনন্দের নামে বিনোদন করতে গিয়ে আমি ঈদের মূল হাকীকতই ভুলে থাকলাম।

আর ঈদের নামে আল্লাহর নাফরমানী এবং বিজাতীয় সংস্কৃতি চর্চার প্রবণতা অত্যন্ত জঘন্য বিষয়, যা ঈদকে (নিআমত লাভের আনন্দকে) ‘ওয়ীদে’ (অভিশাপে) পরিণত করে। ঈদকে উপলক্ষ করে শরীয়তবিরোধী বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, বিনোদনের নামে বিভিন্ন অশ্লীলতার ‘শুভমুক্তি’ হয়। এহেন আচরণ ইসলামের শিআরের সাথে জঘন্য বেয়াদবী।

ঈদকে উপলক্ষ করে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন কনসার্ট, নাটক ইত্যাদির আয়োজন হয়। পর্দাহীনতা ও অশ্লীলতার চর্চা হয়। এগুলো তো সর্বাবস্থাতেই পরিত্যাজ্য। তথাপি আল্লাহপ্রদত্ত ঈদকে তাঁর নাফরমানিতে ব্যয় করা আরো ভয়াবহ।

ঈদকে কেন্দ্র করে সমাজে যে প্রবণতার ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়েছে তা হচ্ছে ঈদ শপিং। রমযানুল মুবারকের মূল উদ্দেশ্য তাকওয়া হাছিল করা এবং ঈমান আমলের উন্নতি করা। এগুলো বিসর্জন দিয়ে ঈদ শপিং এবং মেকআপ-ম্যাচিংয়ে বিভোর থেকে আখের আমি কীসের ঈদ করতে চাচ্ছি! তা কি একবার ভেবে দেখেছি! ঈদ কার জন্য? ঈদ তো তার জন্য, যে রমযানকে গনীমত মনে করে এর কদরে অগ্রগামী হয়েছে। ঈদ তো তার জন্য, যে ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে আমলের মাঝে রমযান অতিবাহিত করেছে। ঈদ তো তার জন্যে যে আল্লাহর হুকুম পালন করেছে। এখন তাঁর রহমত ও মাগফিরাত প্রত্যাশা করছে।

তাই ভেবে দেখা দরকার, ঈদের দিনের আমার আনন্দ-উল্লাস আবার ঈদকে ‘ওয়ীদ’-এ পরিণত করছে না তো! আল্লাহ তাআলা নফস ও শয়তানের ধোঁকা ও প্রবঞ্চনা থেকে সবাইকে হেফাযত করুন।

পরিশেষে আল্লাহর দরবারে মিনতি রমযান ও ঈদ আমাদের জীবনে বয়ে আনুক আনন্দের বার্তা। ভ্রাতৃত্বের সওগাত। সকল অশান্তির অবসান ঘটুক। প্রতিষ্ঠিত হোক সাম্য, সততা, উদারতা ও পরার্থপরতার পরিবেশ। ঈমানী আবেশে গড়ে উঠুক মুসলিম সমাজ। আলোকিত হোক আমাদের ব্যক্তি, ঘর, পরিবার ও রাষ্ট্র।

রমযান ও ঈদে আমরা স্মরণ করি আমাদের ভাই-বোনদের, যাদের জীবন  থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে রমযান, কেড়ে নেওয়া হয়েছে ঈদ ‘আমানূ বিল্লাহ’-এর অপরাধে। মহান রাব্বুল আলামীন সকল মজলুম মুসলিম ভাইদের সহায় হোন। আমাদেরকে তাদের পাশে দাঁড়ানোর তাওফীক দিন আমীন, ইয়া রাব্বাল আলামীন। 

মন্তব্য করুন: