বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, বৈশাখ ১২ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

ফিচার

সত্যি তাজমহলের শিল্পীদের হাত কেটে নিয়েছিলেন শাহজাহান? 

 প্রকাশিত: ১৪:৩৮, ১৭ মে ২০২২

সত্যি তাজমহলের শিল্পীদের হাত কেটে নিয়েছিলেন শাহজাহান? 

‘লার্জার দ্যান লাইফ’। সাধারণ জীবনের সামনে প্রকাণ্ড বিস্ময় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অতিকায় জীবন বিগ্রহ। অনেক নিদর্শনই মনে আসে। কিন্তু তালিকায় আর যে সব নামই থাক, তাজমহলকে কি বাদ রাখা সম্ভব? যার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই মনে পড়বে ‘একবিন্দু নয়নের জল/ কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জ্বল/ এ তাজমহল।’ আমাদের সকলের হয়েই লিখে গিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।

সেই তাজ। সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম। ভারতের গর্ব। গর্ব সারা বিশ্বের। নীল আকাশের বুকে ফুটে থাকা আশ্চর্য সাদা রঙের সেই শোক-সৌধ। তবু তার শরীরেও লেগেছে বিতর্কের রেশ। দাবি করা হয়েছে, তাজের ভিতরে বন্ধ ঘরে নাকি রয়েছে হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি! দাবি, এখানে নাকি ছিল শিব মন্দির। জয়পুরের রাজপরিবারের সদস্যদের আবার দাবি, তাঁদের জমিতেই তৈরি হয়েছিল তাজমহল। যা নিয়ে এই মুহূর্তে বিতর্কের আঁচ গনগনে। তবে এ লেখায় সম্প্রতি চর্চিত বিষয়গুলি নয়, বরং আমরা ফিরে দেখব আরেক মিথকে।

সেই মিথ এক নৃশংস শাসকের ছবি তুলে ধরে। স্ত্রীর প্রয়াণে আকাশছোঁয়া সৌধ নির্মাণ করা শাহজাহান নাকি তাজমহল তৈরি করা ২০ হাজার শিল্পী-শ্রমিকের হাত (মতান্তরে হাতের আঙুল) কেটে নিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য, যাতে ওই সৃষ্টি-নিপুণ আঙুলগুলি আরেকটা তাজমহল বানানোর ‘সাহস’ না দেখাতে পারে। শুনলেই শিউড়ে উঠবেন যে কোনও চেতনাসম্পন্ন মানুষ। চোখের সামনে দেখতে পাবেন, তাজের শুভ্র অস্তিত্বের গায়ে ছিটকে এসে লাগছে রক্তের ছিটে। কেবল ছিটে নয়, হাজার হাজার অসহায় মানুষের রক্তের দীর্ঘ ধারা তাঁরা গড়িয়ে নামতে দেখবেন তাজের মসৃণ শ্বেতপাথরের শরীর দিয়ে। কিন্তু সত্যি কি এমন ঘটেছিল? সে কথায় আসার আগে একবার প্রসঙ্গটা আরেকটু খতিয়ে দেখা যাক।

২০২১ সালের ১৩ ডিসেম্বর। কাশী বিশ্বনাথ ধামের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সেই সময় তাঁকে দেখা যায় মন্দিরের সাফাইকর্মীদের উপরে পুষ্পবৃষ্টি করতে। সেই সময় এক সংবাদমাধ্যমের সঞ্চালক তুলনা টেনে বলেন, মোদির মতো রাষ্ট্রনেতা যেখানে প্রান্তিক মানুষদের এতটা সম্মান দেখালেন, সেখানে শাহজাহান তাজমহলের শ্রমিকদের হাত কেটে নিয়েছিলেন! সেই কথার সুর টেনে কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী নরেন্দ্র তোমারও একই অভিযোগ করতে থাকেন। ক্রমে গেরুয়া শিবিরের
অন্য নেতারাও একই কথার অনুরণন ঘটান সোশ্যাল মিডিয়ায়। এরও কয়েক বছর আগে আমেরিকার ‘দ্য গার্ডিয়ান’ কিংবা ব্রিটেনের ‘ওয়্যারড’ও একই দাবি করেছিল।

কিন্তু সত্যি এমন নির্দেশ দিয়েছিলেন শাহজাহান? আসলে ইতিহাসের সমান্তরালে বহু মিথ গজিয়ে ওঠে। তেমনই এক মিথ এটা। কোনও ইতিহাসবিদ এমন দাবি করেননি। এটা স্রেফ মুখ থেকে মুখে ছড়িয়ে পড়তে পড়তে কখন যেন নিজের শরীরে চাপিয়ে নিয়েছে এক মিথ্যে ইতিহাসের আবরণ। অন্তত তেমনটাই দাবি বহু ইতিহাসবিদের। অন্যদিকে উলটো মতের পক্ষে যাঁরা, তাঁরা কেউই তাঁদের মতের সপক্ষে জোরাল কোনও যুক্তি আজ পর্যন্ত পেশ করতে পারেননি।

১৯৭১ সালে রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে প্রকাশিত ‘জার্নাল অফ হিস্টোরিক্যাল রিসার্চে’ও একই ভাবে একে নিছক ‘মিথ’ বলেই উল্লেখ করা হয়েছে। আবার তাজমহলের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট ঘুরে এলেও এই কাহিনির কোনও হদিশ মিলবে না। উলটে ‘তাজ ট্যুরস’ নামের এক ব্লগে পাওয়া যায় এই সংক্রান্ত একটি লেখা। যেখানে পরিষ্কার বলা হয়েছে, এই দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। কী কী যুক্তি দেখানো হয়েছে সেখানে? বলা হয়েছে, প্রথমত অতজন শ্রমিকের হাত কেটে ফেলা হল, অথচ তাঁদের কারও কাটা হাতের কঙ্কালজাতীয় কোনও রকম প্রমাণ মিলল না? 

দ্বিতীয়ত, সেই সময়ে ভারত ভ্রমণে আসা কোনও পর্যটকের বিবরণ কিংবা সমসাময়িক কোনও বই কোথাও এমন কোনও ঘটনার উল্লেখ নেই। 

তৃতীয়ত, শাহজাহানের আমলকে ‘নির্মাণের স্বর্ণযুগ’ ধরা হয়। এমন নয় যে, তাজমহল ছাড়া আর কোনও স্মরণীয় স্থাপত্যকীর্তি শাহজাহানের আমলে নির্মিত হয়নি। আগ্রায় তাজমহল ছাড়াও রয়েছে মতি মসজিদ। দিল্লিতে রয়েছে জামা মসজিদ ও লালকেল্লা। পরে শাহজাহানাবাদ নামে একটা গোটা শহর গড়ে তোলেন তিনি। যদি তিনি কুড়ি হাজার শ্রমিকের সঙ্গে ওই কাণ্ড করতেন, তাহলে বাকি শ্রমিকরা তাঁর নির্দেশ মানতেন না। তবে এপ্রসঙ্গে একটা কথা বলাই যায়। শাহজাহানের আমল তো
বটেই, গোটা মুঘল যুগেরই সবচেয়ে উজ্জ্বল স্থাপত্যের নাম তাজমহল।

এছাড়াও আরও একটা কথা বলতেই হয়। তাজগঞ্জ নামের জায়গাটির কথা আমরা সকলেই জানি। আজও পর্যটকরা ভিড় জমান সেখানে। মুঘল আমলের দুর্দান্ত সব বাগান, শ্বেতপাথরের কবরস্থান রয়েছে এখানে। এই জায়গাটি তৈরিই হয়েছিল শাহজাহানের আমলের শ্রমিক ও নির্মাণশিল্পীদের থাকার জন্য। যে মানুষ শ্রমিকদের হাত কেটে টুকরো করেন, তিনিই আবার শ্রমিকদের কথা ভেবে এমন এক গঞ্জ তৈরি করে দেবেন?

আসলে যে কোনও গুঞ্জনের পিছনেই থাকে কোনও না কোনও কারণ। এই গুজবের পিছনেও রয়েছে। শাহজাহান তাজমহলের শ্রমিকদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, তাঁরা যেন অন্য কোনও সম্রাট-বাদশাহদের হয়ে কাজ না করেন। সোজা কথায়, এটা ছিল একটা চুক্তির মতো। অর্থাৎ ‘হাত কেটে নেওয়া’ কথাটা আসলে একটা রূপক। ক্রমে সেই রূপক তার ভাবার্থকে ফেলে দিয়ে বাচ্যার্থ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়েছে।

কবে থেকে তা রটল? এক সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমকে ইতিহাসবিদ এস ইরফান হাবিব বলেছেন, ‘এই দাবির সপক্ষে কোনও প্রমাণ নেই। কোনওদিন কোনও খ্যাতিমান ইতিহাসবিদ বা গবেষক এমন ধরনের দাবি করেননি।’ তাঁর মতে, গত শতকের ছয়ের দশক থেকে এটা বেশি করে ছড়াতে শুরু করে। তবে তাঁর মতে, আজকের ভারতবর্ষে এটাকেই একটা সাম্প্রদায়িক চেহারা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। মূলত শাহজাহানকে খোঁচা দিতেই এই হাত কাটার ‘গপ্পো’ রটিয়ে দেওয়া হয়েছে বলেই তাঁর দাবি। 

সেকথাকে অস্বীকার করা যায় না। আসলে এমন নিদর্শন আরও রয়েছে। ইতিহাসকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করার প্রবণতা বহু পুরনো। ইচ্ছেমতো তার শরীরকে বাঁকিয়ে চুরিয়ে অতিরঞ্জন কিংবা একেবারে মিথ্য়ে ঘটনাকে সত্যি বলে দেখানো- নতুন তো নয়। তবে এটাই আনন্দের যে, এই সব মিথের সমান্তরালে রয়েছেন ইতিহাসবিদরাও। তাঁরা এমন সব ‘গপ্পো’কে ইতিহাসের শরীর থেকে সরিয়ে দেওয়ার কাজ করে চলেন। তাদের ‘ঐতিহাসিক’ হতে দেয় না।

মন্তব্য করুন: