ডিজির সঙ্গে তর্ক: নিঃশর্ত ক্ষমা চাইলেন সেই চিকিৎসক
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পরিদর্শনে আসা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক-ডিজি মো. আবু জাফরের সঙ্গে তর্কে জড়ানো চিকিৎসক কারণ দর্শানোর নোটিস পাওয়ার পর নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছেন।
রোববার বেলা ১১টার দিকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালকের কাছে শোকজের জবাব দেন সহকারী অধ্যাপক চিকিৎসক ধনদেব চন্দ্র বর্মণ।
বিষয়টি নিশ্চিত করে বেলা ২টার দিকে মোবাইল ফোনে ধনদেব বর্মণ বলেন, “শোকজের চিঠি হাতে পেয়ে বেলা ১১টার দিকে হাসপাতালের পরিচালকের কাছে জমা দিয়েছি। ডিজি বয়স্ক মানুষ, আমারও বেয়াদবি হয়েছে। শোকজের জবাবে আমি আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করে নিঃশর্ত ক্ষমতা চেয়েছি।”
শনিবার ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান মিলনায়তনে আয়োজিত সেমিনারে অতিথি হিসেবে যোগ দেন স্বাস্থ্যের ডিজি আবু জাফর। সেমিনারে যোগ দেওয়ার আগে তিনি হাসপাতাল পরিদর্শন করেন।
এ সময় হাসপাতালের ক্যাজুয়ালটি অপারেশন থিয়েটার পরিদর্শনে গিয়ে ডিজি কক্ষের ভেতরে টেবিল থাকার কারণ জানতে চান চিকিৎসকদের কাছে। তবে জরুরি বিভাগের ক্যাজুয়ালটি ইনচার্জ ধনদেব চন্দ্র বর্মণ তার সঙ্গে তর্কে জড়ান।
ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অসদাচরণ করায় বিকালে ধনদেব বর্মণকে শোকজ করেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. গোলাম ফেরদৌস। তাকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নোটিসের জবাব দিতে বলা হয়।
দুপুরে হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) চিকিৎসক মুহাম্মদ মাইনউদ্দিন খান বলেন, “আমরা ওই চিকিৎসককে শোকজ করেছি, দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছি। তার বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেবেন।”
অব্যাহতি পাওয়ার পর চিকিৎসক বলেন, ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলছে স্বাস্থ্যসেবা’
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পরিদর্শনে গিয়ে এক চিকিৎসকের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক-ডিজি মো. আবু জাফরের তর্কে জড়ানোর ঘটনা নিয়ে চলছে নানা আলোচনা সমালোচনা।
শনিবার ঘটনার পর তাৎক্ষণিক অব্যাহতি পাওয়া চিকিৎসক ধনদেব চন্দ্র বর্মণ দেশের চিকিৎসা সেবা নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি দেশের স্বাস্থ্যসেবা ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলছে’ বলে মন্তব্য করেছেন। সেইসঙ্গে ১৭ বছর পদোন্নতি না পাওয়ার কারণও তুলে ধরেছেন।
ঘটনার পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা হয় চিকিৎসক ধনদেব চন্দ্র বর্মণের। তিনি বলেন, “আমরা সবসময় মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকি যে কোনো দুর্ঘটনা যেন না ঘটে। ২০২৩ সালের অগাস্ট থেকে আমি এখানে আছি। এ পর্যন্ত কোনো দুর্ঘটনা বা কেউ কারো সঙ্গে মিসবিহেব করছেন, ক্যাজুয়ালটিতে ভাঙচুর হয়েছে বা কোনো কিছু এরকম হয়নি।”
হাসপাতালের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের পরিচালক স্যার, সহকারী পরিচালক এবং ডেপুটি ডিরেক্টর স্যারের তত্ত্বাবধানে আমরা খুব সুন্দরভাবেই চালাচ্ছি। ডিজির কাছ থেকে গুরুজনের মতো ব্যবহার আশা করেছিলাম।
“কিন্তু তিনি এসে কী কী সমস্যা, সেগুলো জানতে না চেয়ে ভেতরে কেন টেবিল, এ নিয়ে কথা বলেন। আমি তিনবার ওনাকে (ডিজি) নাম বলার পরেও উনি আমাকে ‘তুচ্ছ তাচ্ছিল্য’ করে কথা বলছিলেন।”
চাকরি বেশিদিন নাই জানিয়েছে চিকিৎসক ধনদেব চন্দ্র বলেন, “আর এক বছর পরেই আমি পিআরএলে চলে যাব। আমি অনেক সিনিয়র, ২০১৩-তে এমএস করেছি, অথচ ২০২৫-এ আমাকে সহকারী অধ্যাপক বানাইল।
“আমি জেনারেল সার্জান। অথচ আমার হাসপাতালের ভেতরে কোনো অপারেশন করার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য হয়নি। যেটাই হোক, এই প্রেক্ষাপটের জন্য দায়ী আমি মনে করি, কর্তৃপক্ষের অবহেলা। মানে আমাদের এ রকম আরও ম্যানপাওয়ার আছে, যেগুলো আমরা কাজে লাগাইতে ব্যর্থ। আমাদের সঠিক লোককে সঠিক জায়গায় কাজে আমরা দিতে পারি না।”
তিনি বলেন, “আমার গাইনি ডিপার্টমেন্টের ডাক্তার, এখানে আবার জেনারেল আছে। তার উচিত গাইনি ডিপার্টমেন্টে কাজ করা। এগুলো মিস ম্যানেজমেন্ট, পোস্টিংয়ের নামে এগুলো আমি দেখি। আসলে কী বলব, স্বাস্থ্য সেবাটা পুরাটাই একটা উদ্ভট উটের পিঠে চলছে।”
এ ছাড়া স্বাস্থ্য নিয়ে যারা রাজনীতি করে, তারাও পলিটিক্সের সময় আসে খোঁজ নেয়; পরে আর কোনো আলোচনা হয় না বলে অভিযোগ করেন সহকারী অধ্যাপক ধনদেব বর্মন।
চিকিৎসা পেশার গবেষণা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, “এদেশে সঠিকভাবে গবেষণাও হয় না। একটা জায়গা নীলক্ষেত, ওখানে সবাই রিসার্চ পেপার জমা দেন, এগুলো করে সত্যিকারের কোনো রিসার্চই হয় না। স্বাস্থ্যসেবা পুরোটাই একটা ভ্রান্তির মধ্যে চলছে। আমি এগুলো দেখে খুব ত্যক্ত-বিরক্ত।
“ওনাকে (ডিজি) আমি গুরুজনের মতো মনে করছিলাম, যে আমাদেরকে গাইডলাইন দেবেন। উনি এসে বলে যে এটা কি, সেটা কি, টুল কেন নাই, এই নাই। উনি এসে বলত, আপনার কি কি দরকার তাহলে আমি বলতাম, যে স্যার আমাদের এরকম আরও দরকার। যাতে আরও আপগ্রেডেডভাবে কাজটা করতে পারি।”
স্বাস্থ্যের ডিজির বায়োমেট্রিক নিয়ে প্রশ্ন তোলার সমালোচনা করে ধনদেব চন্দ্র বর্মণ বলেন, “আমি প্রতিদিন আসি, দিন রাত আসি। কোনো সমস্যা হলে রাত ৩টা থেকে ৪টার দিকে ছুটে আসি। এগুলো কোনো মূল্যায়ন হয় না। আর উনি বায়োমেট্রিক নিয়ে চিন্তা করেন?
“বায়োমেট্রিক দিয়ে আমাদের কি হবে? হাসপাতালে ২৪ ঘণ্টাই আমরা রিলেটেড থাকি। আমাকে বিহেব শেখান? আমার লাইফ শেষ। এখন আমার চাকরি শেষের দিকে, আজকে আমার ফ্রেন্ডরা সবাই প্রফেসর হয়ে গেছে বিভিন্ন সেক্টরে। আমার বিভিন্ন কারণে হয়নি, ট্রেনিং পোস্ট পাইতে পাঁচ বছর দেরি করতে হইছে।
“ডিজি অফিসে দেখায়, কি যে আপনি! যান নেতাকে ধরেন। নেতাকে ধরে ট্রেনিং পোস্ট নেন। এই ধরনের কথাবার্তা ডিজি অফিস থেকে শুনতে হয়। সবকিছু মিলিয়ে আমি স্বাস্থ্য সেবাটাকে মনে করি ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলছে’, এবার মনে হয় সক্ষম কেউ না।”
এসব নানা কারণে চাকরি থেকে সাসপেনশন হলে খুশি হবেন বলে জানান চিকিৎসক ধনদেব চন্দ্র বর্মণ।
যে কারণে পদোন্নতি পাননি
২০১৩ সালে এমএস ডিগ্রি অর্জনকারী ধনদেব বর্মণ মাত্র চার মাস আগে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পান। দীর্ঘ সময়ে তিনি কেন পদোন্নতি পাননি, সে বিষয়ে অনুসন্ধানে জানা গেল নানা তথ্য।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের ১৬ বছরে ধনদেব বর্মণ কোনো পদোন্নতি পাওয়ার প্রক্রিয়া অনুসরণ করেননি।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ধনদেব বর্মণ ময়মনসিংহ শহরে থেকে বিভিন্ন ক্লিনিকে অপারেশন করার সুবিধা নেওয়ার জন্য আগে পদোন্নতির আবেদন করেননি। পদোন্নতির একটি ক্রাইটেরিয়া হল বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন জমা দেওয়ার। সেক্ষেত্রেও তার অবহেলা ছিল অভিযোগ পাওয়া গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেন, “অবহেলা করে চিকিৎসক ধনদেব বর্মণ ফাউন্ডেশন ট্রেনিং করেননি, ডিপার্টমেন্টাল পরীক্ষায় পাশ করেননি, সিনিয়র স্কেল পরীক্ষাই দেননি। পদোন্নতির ক্রাইটেরিয়াগুলো তিনি পূর্ণ করেননি।
“তাই আওয়ামী সরকার তাকে পদোন্নতি দেয়নি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাকে ইনসিটু পদোন্নতি দিয়েছে। চলতি বছরের ২৯ জুলাই ধনদেব বর্মণ সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পান।”