শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, বৈশাখ ৭ ১৪৩১, ১১ শাওয়াল ১৪৪৫

ফিচার

শাপলা যেখানে ১০ হাজার মানুষের জীবিকা

 প্রকাশিত: ১১:০৯, ৫ আগস্ট ২০২২

শাপলা যেখানে ১০ হাজার মানুষের জীবিকা

বর্ষার পানিতে টাই টম্বুর বিল। এ সময় বিল এলাকার মানুষের কোন কাজ থাকে না। বছরের ৭ মাস বিল জলমগ্ন থাকে। মে মাসের মাঝামাঝি থেকেই বিলে জন্মাতে থাকে জলাজ উদ্ভিদ শাপলা। নভেম্বর পর্যন্ত বিলের শোভাবর্ধণ করে জাতীয় ফুল শাপলা।

সূর্যোদয়ের আগে বিলের পানির ওপর সাদা শাপলা ফুল শ্বেত শুভ্র আভা ছড়াচ্ছে। বিল এলাকার কর্মহীন মানুষ কাকডাকা ভোর ৫ টা থেকে নৌকায় করে বিলে শাপলা সংগ্রহে নামেন। সকাল ৮ টা পর্যন্ত ৩ ঘন্টায় তারা ৩ শ’ থেকে ৪ শ’ শাপলা তোলেন। এ শাপলা তারা ৬ শ’ থেকে ৮ শ’ টাকায় বিক্রি করেন। গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী উপজেলার সিঙ্গা গ্রামের বড় সিঙ্গা বিলের চিত্র এটি। ওই গ্রামের ১ হাজার ৫ শ’ মানুষ বিল থেকে শাপলা সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। ওই গ্রমে প্রতিদিন ২ লাখ টাকার শাপলা কেনা বেচা হচ্ছে। এখান থেকে পাইকেররা শাপলা কিনে পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা নিয়ে যান। এ কারণে শাপলার কদর ও দাম বেড়েছে। এছাড়া এই শাপলা খুলনা, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চালান করা হচ্ছে। শাপলা চালানের সাথে জড়িতরাও মোটা অংকের টাকা আয় করছেন।

কাশিয়ানী উপজেলার সিঙ্গা গ্রামের সমর বিশ্বাস (৫৫) বলেন, বর্ষাকালে বিল জলমগ্ন হয়ে পড়ে। তাই মানুষের কোন কাজ থাকে না। তারা বিল থেকে শাপলা সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এ পেশার সাথে আমাদের গ্রামের বিভিন্ন বয়সের ১ হাজার ৫ শ’ নর-নারী জড়িয়ে রয়েছেন। পদ্মা সেতু চালুর পর শাপলা সংগ্রহকারীরা শাপলার একটু বেশি দাম পাচ্ছেন।

কাশিয়ানী উপজেলার সিঙ্গা গ্রামের রিনা রানী সরকার (৫৮) বলেন,বিলে প্রাকৃতিক ভাবে শাপলা ফোঁটে। ভোর ৫ টায় নৌকায় পান্তাভাত, মুড়ি অথবা চিড়ে নিয়ে বিলে যাই। বিলে গিয়ে শাপলা তুলি। সকাল ৮ টা পর্যন্ত আমি ৩ শ’ শাপলা তুলতে পারি। ১০টি শাপলা দিয়ে একটি আঁটি বাঁধি। ১০টি আঁটি দিয়ে ১ শ’ শাপলার একটি বান্ডিল করি। আগে প্রতি বান্ডিল শাপলা ১ শ’৫০ টাকা দরে বিক্রি করতাম। পদ্মা সেতু চালুর পর প্রতি বান্ডিল শাপলা ২ শ’ টাকা দরে বিক্রি করছি। সে হিসেবে প্রতিদিন আমি ৬ শ’ টাকার শাপলা বিক্রি করতে পারি। বিলে নৌকা থেকেই পাইকের নগদ টাকায় শাপলা কিনে নেন। এটি আমাদের বিনা চালানের ব্যবসা। একটু শ্রম দিয়েই প্রতিদিন ৬ শ’ টাকা আয় করে সংসারের খরচ মেটাতে পারছি। 

ওই গ্রামের অতুল বিশ্বাস (৬০) বলেন, আমাদের বিলে রক্ত, সবুজ ও গুন্দি শাপলা জন্মায়। এরমধ্যে সবুজ শাপলা ক্ষেতে খুবই সুস্বাদু। বাণিজ্যিকভাবে এ শাপলার চাহিদা সবচেয়ে বেশি। এ জাতের শাপলা একটু বেশি দামে বিক্রি হয়। আমি সকাল বিকেল দুই বেলা বেঁছে বেঁছে বিল থেকে সবুজ শাপলা তুলি। এতে প্রতি দিন ১ হাজার ৫ শ’ টাকা আয় করতে পারি।

শাপলার পাইকের সুকুমার বিশ্বাস (৪০) বলেন, সিঙ্গা বিলের মিঠা পানির শাপলা খুবই সুস্বাদু। সারাদেশে এ শাপলার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তাই এখান থেকে শাপলা কিনে আমরা ঢাকা, খুলনা,বরিশালসহ বিভিন্ন জেলায় চালান করি। প্রতি বান্ডিল শাপলা আমরা ২ শ’ টাকা দরে ক্রয় করি। এ শাপলা আমরা ৩ শ’ টাকা বান্ডিল দরে বিক্রি করি। পদ্মা সেতু চালুর পর শাপলার কদর ও দাম বেড়েছে। এতে আমরা ও শাপলা সংগ্রহকারীরা লাভবান হচ্ছি। জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত আমাদের শাপলার ব্যবসা চলে। 

গোপালগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণের ডিডি ড. অরবিন্দু কুমার রায় বলেন,  গোপালগঞ্জ জেলার ৫ উপজেলায় ছোট বড় ২২৯ টি বিল রয়েছে। প্রতিটি বিলে প্রচুর শাপলা জন্মে। শাপলায় প্রচুর পরিমাণ আয়রন, সিলিকন ও আয়োডিন রয়েছে। এ উপাদান গুলো মানবদেহের জন্য খুবই উপকারী। আমাদের দেশে শাপলা সবজি হিসেবে খাওয়া হয়। এ জেলার অন্তত ১০ হাজার মানুষ শাপলা সংগ্রহ ও চালানের সাথে জড়িত রয়েছেন। পদ্মা সেতু চালুর পর শাপলার দাম বেড়েছে। গ্রামের মানুষ শাপলা সংগ্রহ করে ৬ শ’ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করছেন। এ জেলায় প্রতিদিন ১০ লাখ টাকার শাপলা বিক্রি হচ্ছে। 

মন্তব্য করুন: